উৎসবের ঘনঘটা কোনো অংশে আগের তুলনায় বেশি কিছু ছিল না। স্টাইলও একই। সেই কেক কাটা, নৈশভোজ, গানবাজনা এবং র্যাফেল ড্র। তারপরও মন ছুঁয়ে যাওয়া একটি সন্ধ্যা ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৬১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর রাতটা। ২৮ অক্টোবর, ২০১৫-এর দিবাগত রাত। এর বেশকিছু কারণ আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাললাগার কারণ ক্লাবের সদস্য হওয়ার একযুগ পর মনে হয়েছে এটা প্রফেশনাল সাংবাদিকদের ক্লাব। তাদের বার্ষিক মিলন মেলা।প্রতিবার, মনে হয় সদস্য হওয়ার পর ১০/১২ বার, মনে হয়েছে কোথায় যেন কমতি আছে। এবার সেই কমতিটা ততটা উপলব্ধি হয়নি কারণ এই ক্লাবে যোগ হয়েছে ৫৭১ জন নতুন সদস্য। মুহম্মদ শফিকুর রহমান এবং কামরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ক্লাবটি যেন প্রাণ পেয়েছে প্রথমবারের মতো। এর প্রধান কারণ পুরনোদের সঙ্গে নতুন সদস্যদের অংশগ্রহণ। সদস্যরাও কোনো না কোনো রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী হলেও তারা সিংহভাগ মাঠে দেখা হওয়া সংবাদকর্মী। অনেকে প্রফেশনে খ্যাতনামাও। আগের মতো শুধু রাজনৈতিক আনুকূল্যে সদস্য হননি তারা।আমার কাছে এর বাড়তি গুরুত্ব ছিল আগে যাদেরকে গেইটের বাইরে বিদায় দিয়ে ক্লাবের ভেতরে ঢুকতে হত তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এবার গল্প করেছি। একসঙ্গে খেয়েছি। ছবি তুলেছি। মধুর কিছু সময় পার করেছি। একান্ত ব্যক্তিগত খুশির আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমার স্ত্রী প্রথমবার আমার সঙ্গে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে গেলেন। একটা সময় বাচ্চারা ছোট ছিল, তাদেরকে কোথায় রেখে যাব- এই ভাবনাতে যাওয়া হতো না। এবার সেটাও অনেকটা সামাল দেওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম থেকে অরিজিনাল বাবুর্চি পাঠিয়ে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মেজবানীর আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। এমন একটা মেজবান অনুষ্ঠান বর্জন করা মোটেও শুভবুদ্ধির কাজ হতো না। আর যাওয়ার কারণে লটারি ভাগ্যে একটা ডায়মন্ড নাক ফুলও মিললো, যাতে ছোট্ট হলেও সুন্দর তিনটি ডায়মন্ড বসানো আছে।যাই হোক, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই মিলন মেলা, এই মেজবানের আগে আগেই ক্লাবটি সদস্যদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। জাতীয় সংবাদেও স্থান পেয়েছে। সেটার কারণ ১০১ জনকে সদস্য পদ দেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আরও ৪৭০ জনকে ক্লাবের সদস্যপদ প্রদান, যার মধ্যে ১০ জন সহযোগী সদস্য। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও আলোড়ন তুলেছে এই সদস্যপদ দেওয়ার খবর। সদস্যপদ প্রাপ্তি নিয়ে অভিনন্দনের বন্যা আর না প্রাপ্তি নিয়ে হতাশার সুর সে পোস্টগুলোতে দেখা গেছে।যোগ্যতা থাকার পরও কেন সদস্য হতে পারেননি- বেশিরভাগ অভিযোগ এ রকম। তবে আমার মনে হয়, এই অভিযোগ উঠতো না যদি এতো অধিক সংখ্যক সাংবাদিক সদস্যপদ না পেতো। বাঙালিদের এক অদ্ভুত চরিত্র। আমরা নিজে পেলাম না কেন তার চেয়ে বেশি হতাশ হই অন্যে পেল কেন সেটা নিয়ে। একবার আমার কর্মস্থলে আমার বেতন বেড়ে কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হল। আমার এক সহকর্মী পদত্যাগ করলেন সেই ক্ষোভে। কর্তৃপক্ষ আবার তাকে উচিত শিক্ষা দিতে সেটা গ্রহণও করল। আরেকবার সেই অফিসেই প্রথম বিশেষ প্রতিনিধির মর্যাদা পেলাম আমি। প্রধান প্রতিবেদক কর্তৃপক্ষকে বললেন, উনিতো আর আমার কথা শুনবেন না। শুনে আমি বললাম, কোনো রিপোর্টারই প্রধান প্রতিবেদকের অধীনস্ত কর্মচারি নয় যে তার কথা শুনবে। সবাই সম্পাদকের অধীনস্ত। প্রধান প্রতিবেদক রিপোর্টারদের মধ্যে জাস্ট একটা কো-অর্ডিনেটর। সে পদের মর্যাদা তিনি আগের মতোই পাবেন। দু’ক্ষেত্রেই আসলে বলা উচিত ছিল- বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতিটা আমারও দরকার। আদায়ও সহজ ছিল- কারণ উদাহরণ সৃষ্টি করা আছে।প্রেস ক্লাবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কোনো মেম্বার করা হচ্ছিল না ক্লাবে। প্রায় দুই দশক ধরে এক তরফা নির্বাচন হচ্ছিল। সীমিত সংখ্যক সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছিল। বিএনপি’র নামে জামাতে ইসলামী দলের অনুসারীরা অতি মাত্রায় সদস্যপদ পাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি বা আওয়ামী ফোরাম হিসেবে পরিচিতরা সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিলেন। যদি একশ` জনকে সদস্যপদ দেওয়া হয় তার মধ্যে ৭০ জন বিএনপি-জামায়াত ঘরানার সাংবাদিককে সদস্যপদ দেওয়া হয়। ৩০ জন দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। তবে এখানেও অসন্তোষ বিরাজ করছিল যে ৭০ জনের ৫০ জনই জামাত ঘেঁষা এবং ৩০ জনের ২৫ জনই বিশেষ একটা ধর্মের লোক। ভোট প্রাপ্তির একশ ভাগ নিশ্চয়তা যাতে থাকে সেটার জন্য এই সতর্কতা।কোনো দলের সরাসরি অনুসারি নই বলে নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবেদন করেও আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম সদস্যপদ প্রাপ্তি থেকে। অথচ সাংবাদিকতায় জুনিয়র এবং নামধাম কম এমন অনেকে তখন সদস্য হয়েছেন। এতে অবশ্য এতটা খারাপ লাগেনি আমার কারণ পদ্ধতিটা জানা ছিল। ব্ল্যাক বল। দুই দল যদি এক না হয় কেউ সদস্য হতে পারবে না। পরস্পর পরস্পরের তালিকা অনুমোদন না করলে ব্ল্যাক বলের কারণে কারও সদস্য পদ প্রাপ্তির সুযোগ নেই। আমি কত দেশে যেতাম, সেখানকার প্রেস ক্লাবের সুবিধা ভোগ করতাম, সাংবাদিক পরিচয়ে, কিন্তু নিজ দেশের প্রেস ক্লাবে ঢুকার অধিকার ছিল না। একবার কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাব-এর ঝামেলায় ক্লাবের কেন্টিনে বসতে হয়েছিল আমাদের দু’ সদস্যের সঙ্গে, যারা তখন মেম্বার ছিলেন। কিন্তু সদস্য না হওয়ায় আমার জন্য চায়ের অর্ডার দিলেও পরিবেশন করা হয়নি। আরেকবার গেস্ট রুমে সব সময় নিজের কথায় ‘ইয়েস’ শুনতে চাওয়া এক কবিকে আমি ‘নো’ শোনালে সে আমাকে ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আর কোনো দিন আবেদন করবো না সদস্যপদের জন্য।কিন্তু ইরাক যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ আমার জন্য ক্লাবের দরজা খুলে দিয়েছিল। সদস্য না হলেও ইরাকে থাকাকালে আমার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন ক্লাব নেতারা। দেশে আসার পর আমার এক সহকর্মী বাবু আনসারীর মাধ্যমে আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন, যাতে আমি আবেদন করি। আমি বলেছিলাম যেহেতু আমাকে কোনো ফোরাম ওন করে না- আমার আবেদন করে লাভ নেই। তিনি জানালেন, ক্লাব সিদ্ধান্ত নিয়েছে যৌথভাবে আপনাকে মেম্বারশিপ দিবে। যথারীতি দিয়েছিলও। তবে ২০০৩ সালে আমাদের মেম্বারশিপ দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী ফোরামের লোকদের মতামতকে উপেক্ষা করে এক তরফা অনেকজনকে সদস্যপদ দেওয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।আমাদের সব ক’য়টা পেশাধারী প্রতিষ্ঠানকে ’৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিভক্ত করা হয়েছে। ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক- সব। যেখানে বিএনপি শক্তিশালী ছিল অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছিল। প্রেস ক্লাব তার একটা। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রেস ক্লাবকে ভাগ করা বা দখল করার সুযোগ আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা নেয়নি। জিতবে না জেনেও তারা নির্বাচনী লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে প্রেস ক্লাবে। কিন্তু সেই ধারা এবার তারা বজায় রাখেনি। কারণ প্রেস ক্লাবকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকরা এমন এক আখড়ায় পরিণত করেছিল যে এটা পেশাধার সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হারিয়েছিল। এটা জামায়াত-বিএনপির নেতাদের যেমন আখড়া হতে চলছিল তেমনি শুধু জামাত-বিএনপি সাংবাদিকদের ক্লাবে পরিণত হয়েছিল। জামাতের সমর্থক আর কোনো সিনিয়র-জুনিয়র সাংবাদিক অবশিষ্ট নেই সদস্যপদ পাওয়ার। এমনকি জামাতের পত্রিকার ছাপাখানার লোকও প্রেস ক্লাব সদস্য হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কুখ্যাত দুই যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামান এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিল সেটাতো জানা কথা, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পরও তাদের মেম্বারশিপ বাতিল করা হয়নি। অবশ্য ফাঁসির আগে তা বাতিল করা হয়েছিল। এমনি এক পরিস্থিতিতে চলতি বছর আওয়ামীপন্থী ও বিএনপিপন্থী সাংবাদিকরা, জামাতপন্থী সাংবাদিকদের বাদ দিয়ে ক্লাবকে তার মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যেতে এর নেতৃত্ব দখলে নেন। প্রায় ৬ মাসের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিকে বাদ দিয়ে গঠনতন্ত্রের ধারা মেনেই তারা ক্লাব নেতৃত্ব দখল নেয়। আওয়ামীপন্থীদের থেকে সভাপতি এবং বিএনপিপন্থীদের থেকে সাধারণ সম্পাদক নির্ধারণ করে তারা সম্মিলিত একটি কমিটি করেন এবং ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব দেন তাদের। এই নেতৃত্ব কতটা সহি এটা নিয়ে বিতর্ক উঠে বটে তবে ক্লাবকে বাড়িঘর বানিয়ে বছরের পর বছর কিছু লোক যে পুকুর চুরি করছিল তার হিসাব যখন সদস্যরা দেখেন তাদের চোখ খুলে যায়।চুরিটা কেমন ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই বুঝা যাবে। পর পর ১২ সপ্তাহ পুরনো কমিটি দেখালো যে ক্লাবে যে হাউজি খেলা হয় তাতে লস যায়। কিন্তু বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম সপ্তায় দেখলো ৬ লাখ টাকা লাভ হয়েছে। বাকি কাহিনী জনসম্মুখে বিস্তারিত আনা শোভনীয় নয় মনে করছি।বর্তমান কমিটি দুই দফা প্রায় ৬ শত নতুন সদস্যকে ক্লাব মেম্বারশিপ দিয়ে দীর্ঘদিনের একটি বন্ধ্যাত্বকে দূর করেছেন। এদের মধ্যে বিএনপি জামাতের প্রতি সমর্থন আছে এমন প্রায় ২০০ সাংবাদিক সদস্যপদ পেয়েছেন। বর্তমান কমিটি যদি আরও তিনশ মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামীপন্থী সাংবাদিককে নতুন করে মেম্বারশিপ দেয় হয়তো ক্লাবে একটা রাজনৈতিক ভারসাম্য আসতে পারে। নতুবা নয়। এখনও নির্বাচন দিলে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকদের জিতে আসা কঠিন কারণ ক্লাবের ১৪ শ’র বেশি যে সদস্য সংখ্যা রয়েছে সিংহভাগ বিএনপি-জামাতপন্থী বলে ভোটের হিসাব বলে।আমি বিশ্বাস করি সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে, দু’চারটা ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে না তা নয়। কিন্তু প্রেস ক্লাবকে নিয়ে পুরনো যে অভিযোগ- শুধু দলীয় দালালদের সদস্যপদ দেওয়া হয়, রাজাকারের আন্ডা বাচ্চাদের সাংবাদিক হওয়ার আগেই সদস্যপদ দেওয়া হয় (বিএনপি সমর্থক হলেও নয়)- সেটা বলার আর সুযোগ নেই। যারা সদস্য হয়েছেন তারা সবাই যোগ্যতা বলেই হয়েছেন ধরে নিতে হবে। যারা হতে পারেনি তারা সবাই এদের থেকে অযোগ্য তাও ভাবার কারণ নেই। এটাই সদস্যপদ প্রাপ্তির শেষ সুযোগও নয়। এ নিয়ে দুঃখ করার চেয়ে ক্লাবটিকে প্রফেশনালদের ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাতে হবে। যারা সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে ক্লাবকে নিয়েও নানা অপপ্রচারে লিপ্ত আছেন- আশা করছি সেসব কেটে যাবে। আর তা কাটানোর কঠিন চ্যালেঞ্জও কিন্তু বর্তমান কমিটির।লেখক: সাংবাদিকanisalamgir@gmail.comএইচআর/এমএস
Advertisement