স্বাস্থ্য

চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হবে টেলিমেডিসিনে

করোনা মহামারিকালীন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে টেলিমেডিসিন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-এর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বর্তমানে চিকিৎসক ও রোগীর সরাসরি যোগাযোগ অনেকাংশেই বন্ধ।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনও হলো- গুরুতর না হলে হাসপাতালে না যাওয়াই ভালো। এক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে সবার চিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি।

গবেষকরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আগেভাগেই এএমডি, ডিআর ও গ্লুকোমাজনিত সমস্যার বিষয়ে জেনে প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। অকাল অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পেতে পারে অনেক মানুষ। আরও অনেক জটিল রোগ আগাম নির্ণয়েও এর ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে সর্বাধুনিক এই প্রযুক্তি।

২৬ জুলাই ‘টেলিহেলথ এ নিউ নরমাল: হোয়াট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ক্যান ডু?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে দুই খ্যাতিমান চিকিৎসা ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী এসব বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আলোচনায় অংশ নেন মাউন্ট সিনাইয়ের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের চক্ষুবিদ্যা বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক ড. থিওডোর স্মিথ, এমডি, পিএইচডি এবং আইহেলথস্ক্রিন ইনকরপোরেশন ইউএসের প্রতিষ্ঠাতা, সিইও এবং মাউন্ট সিনাইয়ের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন ভূঁইয়া, পিএইচডি।

Advertisement

বাংলাদেশ থেকে সঞ্চালনা করেন ফ্যাকো, লেসিক ও ভিট্রেও-রেটিনা বিশেষজ্ঞ এবং ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর রাকিব তুষার এমডি, এফসিপিএস (চক্ষুবিদ্যা)।

ড. থিওডর স্মিথ বলেন, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে বিশেষভাবে এইজ রিলেটেড ম্যাকুলার ডিজেনারেশন ডিজিজ (এএমডি), ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (ডিআর) ও গ্লুকোমা সম্পৃক্ত অন্ধত্ব থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। আগাম রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধে এ প্রযুক্তি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা’।

অধ্যাপক স্মিথ বলেন, ‘মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণায় ৯৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। এএমডি, ডিআর ও গ্লুকোমার ক্ষেত্রে এটা বিশাল অর্জন। চোখের রেটিনাজনিত রোগ আগাম নির্ণয় করা গেলে বিপুলসংখ্যক মানুষকে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে’।

‘ডিআর স্ক্রিনের উপর ড. আলাউদ্দিন ভুইয়া ও আমার করা গবেষণা ফলাফল সম্প্রতি ডায়াবেটিস নিয়ে বিশ্বের শীর্ষ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এএমডি স্ক্রিনিং ও পূর্বানুমানের উপর গবেষণা ফল প্রকাশিত হয়েছে ট্রান্সলেশনাল রেটিনাল গবেষণার শীর্ষ জার্নাল টিভিএসটিতে’।

Advertisement

রেটিনা-মেডিকেল ও সার্জিকাল চক্ষুবিদ্যার বিশেষজ্ঞ এবং মাউন্ট সিনাইয়ের নিউইয়র্ক আই অ্যান্ড ইয়ার রেটিনাল ইমেজিং ল্যাবরেটরির এ পরিচালক বলেন, ‘টেলিমেডিসিন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দুটোই খুব শক্তিশালী চিকিৎসা প্রযুক্তি মাধ্যম। বিশেষ করে বর্তমান করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতে টেলিমেডিসিন প্রযুক্তির গুরুত্ব আরও বেড়েছে’।

ড. স্মিথ বলেন, ‘দু’জনের শারীরিকভাবে মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন নেই। ফলে অনেক রোগের ক্ষেত্রেই রোগী দ্রুত সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাবেন। রোগী শুধু তার উপসর্গের কথা চিকিৎসককে জানাবেন, চিকিৎসকের কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে সেটিও তিনি করতে পারবেন। এটা চিকিৎসক-রোগী একেবারে মুখোমুখি বসে কথা বলার মতোই প্রযুক্তি’।

অধ্যাপক স্মিথ রেটিনার রোগ নির্ণয় ও প্রতিরোধে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেজেন্স ব্যবহারের তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন, ‘চোখের রোগ নির্ণয়ে এটি অ্যাডভান্স লেভেলের প্রযুক্তি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগে দ্রুত কার্যকর ফল পাওয়া যাবে। নিশ্চিত অন্ধত্ব থেকে বাঁচতে পারেন অনেক রোগী’।

ড. আলাউদ্দিন ভুইয়া বলেন, ‘আমরা এএমডি, ডিআর ও গ্লুকোমা স্ক্রিনিয়েং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারে প্রায় শতভাগ কার্যকারিতার প্রমাণ পেয়েছি। সেই সাফল্যের সূত্র ধরেই বলা যায়, এআই ক্লিনিকাল প্রয়োগে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। এই প্রযুক্তি যদি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায়, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় তা বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে’।

‘টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের এই প্রযুক্তির কল্যাণে ইউনিয়ন পর্যায়েও বিশেষায়িত সেবা পাবেন মানুষ। চিকিৎসক সংকটের বাস্তবতায় প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে যেখানে সাধারণ একজন চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাবেন তারা। বাংলাদেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা আমূল পাল্টে দিতে পারে টেলিমিডিসন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’।

চিকিৎসা প্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা এ উদ্ভাবক ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী আরও বলেন, ‘স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস পূর্বানুমানে আমরা গভীরভাবে কাজ করেছি। আমাদের প্রযুক্তি শিগগিরই ক্লিনিকে চলে আসবে। নিঃসন্দেহে বিপুলসংখ্যক মানুষকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবে আমাদের উদ্ভাবন’।

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স বিভাগে শিক্ষকতা করা এই হার্ভাড স্কলার জানান, এএমডি পূর্বানুমান প্রযুক্তি ও ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য সম্প্রতি ১.৫ মিলিয়ন ডলার গ্রান্ট পাওয়া গেছে। অন্যদিকে স্ট্রোক, চোখ ও হৃদরোগ পূর্বানুমান এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য এখন পর্যন্ত ২.৫ মিলিয়ন ডলার গ্রান্ট গ্রহণ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী চিকিৎসা প্রযুক্তির জন্য আমাদের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। আমরা আলজেইমার রোগ স্ক্রিনিং ও প্রতিরোধ নিয়েও কাজ করছি’।

দুই আলোচকের বক্তব্যের সূত্র ধরে খ্যাতিমান চিকিৎসক ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আব্দুর রাকিব তুষার বলেন, ‘টেলিমেডিসিন শুধু করোনা মহামারিকালেই যে জরুরি তা নয়, অন্য যে কোনো স্বাভাবিক সময়েও এটি গুরুত্বপূর্ণ। করোনার সময়ে হয়তো এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। সেইসঙ্গে টেলিমেডিসিন শুধু বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দেশের ক্ষেত্রে নয়, সারাবিশ্বেই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইতোমধ্যে এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে’।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্যাটরেট অ্যান্ড রিফ্রেক্টিভ সার্জনস (বিএসসিআরএস)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. তুষার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘একশ কিলোমিটার দূরের কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে গিয়ে বারবার চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসা কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে চিকিৎসক তার সুবিধাজনক স্থান থেকে টেলিমেডিসিন ব্যবস্থায় রোগীকে সেবা দিতে পারবেন। সেইসঙ্গে রোগীকেও বারবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে না। তাই বলা যায়, চিকিৎসক ও রোগী দু’জনের দৃষ্টিকোণ থেকেই টেলিমেডিসন বিশেষ সুবিধা নিয়ে এসেছে’।

এমআরএম/এমএস