একেই বলে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামাল দিতে যখন আমরা হিমশিম খাচ্ছি গোটা দেশ তখন বানের পানিতে ভাসছে। আর এমন সময় এলো কোরবানির ঈদ। এই তিন ধাক্কা সামাল দিতে জনগণের ত্রাহিমধুসুধন অবস্থা। অনেকেই আজ করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে ঘরে বসে আছেন। হাতে সংসার চালানোর অর্থ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যেও চরম সংকট চলছে। এই সংকট কিছুটা যখন কাটতে শুরু করেছে ঠিক তখনই বন্যার পানিতে দেশ ভাসছে। অনেক জেলাতেই এখন বানের পানি। নানা সংকটের পাশাপাশি বন্যা এবং করোনাভাইরাসজনিত মৃতু বাড়ছে। এমন কষ্টের দিনেই আনন্দের ঈদ এসে হাজির। ঈদ যে কেবল আনন্দের তা কিন্তু নয়। গরিব মানুষের জন্য ঈদটা কখনো কখনো অনেক কষ্টের বটে! সন্তান, স্বজন আর পিতা-মাতাকে নতুন কাপড় না দেয়ার কষ্ট; ভালো খাবার দিতে না পারার কষ্ট গৃহকর্তার থেকেই যায়।
Advertisement
করোনায় বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে বানের পানিতে যখন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন ঈদ কতটা আনন্দের তা বেশ টের পাচ্ছি আমরা। রোজার ঈদের মতো এবারের ঈদটা আমাদের জন্য খুব একটা আনন্দ বয়ে আনছে তা বলা যাবে না। যারা ধনী তাদের কথা ভিন্ন, তবে সবার সুখের সাথে সাথেইতো ঈদেও আনন্দের সম্পর্ক। সবাই মিলে আনন্দ করতে না পারলে সে আনন্দ পূর্ণতা পায় না। করোনা, বান আর ঈদ এই তিন সংকটের মধ্যে আতঙ্ক আরেক সংকট। ঈদের কোরবানির হাট আর ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে রয়েছে ঝুঁকি। এই ঝুঁকি করোনার প্রকোপ বাড়া এবং মৃত্যুও শঙ্কা তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে আমরা যে বর্তমানে মহাসংকটে আছি এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনাভাইরাস প্রকোপের মধ্যেই দেশে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে যে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে এ জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? দেশের বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে অনেক এলাকা। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। কারণ বন্যার প্রকোপটা এখনই বেশি দেখা দিচ্ছে। সামনে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও বন্যা হওয়ার শঙ্কা আছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্যা মোকাবিলায় সরকার যথেষ্ট প্রস্তুত। বন্যা মোকাবিলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। তবে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের একের পর এক সংকট মোকাবিলা করা একটু দুরূহই বটে। তবে এ পর্যন্ত সরকারের ত্রাণ সফলতায় আমরা খুশি হতে পারি। এ বিষয়টিতে সরকারের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় আরও বেশি সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আমরা আশা করি।
Advertisement
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বন্যার খবর জোরেশোরে প্রকাশ হচ্ছে। খবরের কাগজে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের দুঃখকষ্টের কথা তুলে ধরা হচ্ছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম ততটা পর্যাপ্ত নয়, ইত্যাদি লেখা হচ্ছে। ত্রাণ যতই দেয়া হোক ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছবে এবং মানুষের চাহিদা শতভাগ পূরণ হবে তা ভাবা হয়তো ভুল হবে। বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বার্ষিক ঘটনা। প্রতিবছরই আমরা বন্যার কবলে পড়ি। কোনো বছর বেশি মাত্রায়, কোনো বছর কিছুটা কম। কোনো বছর কিছুটা আগে, কোনো বছর কিছুটা দেরিতে আসে। এটা নিয়ে আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি বাঞ্ছনীয়। এবারও বোধকরি সরকার প্রস্তুত রয়েছে। তবে করোনার কারণে সারাদেশে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে এখন শতভাগ সফলতা মিলবে কিনা কেউ তা বলছেন।
দেশের বহু জায়গায় পানি বেড়ে তা মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, এটা অত্যন্ত সত্যি কথা। এ কথা সত্য যে করোনা ও বন্যার কারণে এবারের ঈদটা বিবর্ণই হবে। করোনার পর বন্যার প্রকোপ। এই দুয়ের প্রভাবে ঈদের খুশি এবার ম্লান। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঈদের আনন্দের প্রাকপ্রস্তুতি একেবারেই আলাদা। চারপাশে মৃত্যুর হাহাকার। বানভাসি ক্ষুধার্ত মানুষ। এর মধ্যে উৎসব পালনের মানসিকতাই নেই। কোরবানির হাটে আগের সেই জৌলুস নেই। আগের মতো গরু কেনার হিড়িক নেই। গত রোজার ঈদটাও অনেকটা আনন্দহীন ভয়ভীতির মধ্যে ঘরেই কেটেছে। এবার কোরবানির ঈদটাও ঘরেই কেটে যাবে।
ঈদের পর কী হবে? অর্থনীতির কী অবস্থা? অনেকেই এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিকল্প আমদানি-রফতানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের নতুন বাজারের সুযোগ খোঁজা অব্যাহত রেখে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং দেশে তাদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এখন প্রকৃতি এবং মানুষবান্ধব টেকসই মানবকল্যাণমূলক স্বনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে- দক্ষতার সাথে যার নেতৃত্ব দেবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। একমাত্র তিনিই পারবেন এ দেশের ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণকে এক করে আরেকটি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। যে যুদ্ধ হবে ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’।
বাংলাদেশে এখনও ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সংখ্যার হিসাবে প্রায় চার কোটি। মৌলিক চাহিদার অনেক কিছুই তাদের অপূর্ণ থেকে যায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে। করোনা সংকট তাদের রোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, তাতে চাহিদার ২৫ শতাংশও মিটবে না। ৭৫ শতাংশ বঞ্চিত থেকে যাবে। এ অবস্থায় কী করবে সরকার? অবিলম্বে সরকারের ত্রাণ পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যতদিন করোনা সংকট থাকবে, ততদিন কাজ হারানো সব অভাবী মানুষের কাছে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছাতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি প্রত্যেক মানুষকে ছয় মাস বিনা পয়সায় চাল দিতে পারে, আমরা কেন পারব না?
Advertisement
বৈশ্বিক যেকোনো মহামারিকে পরাভূত করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক দক্ষ নেতৃত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক শাসনতন্ত্র ও সঠিক কর্মকৌশল। করোনা সংক্রমণরোধ ও মহামারির পর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় কৃষিজমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া দরকার। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও অধিকতর উৎপাদনশীল কৃষিতে আমাদের মনোযোগ বেড়েছে। একইসঙ্গে চাহিদা অনুসারে কৃষিপণ্যের আমদানি না বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদনে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।
সর্বশেষ এটাই বলব, আমরা যোদ্ধার দেশের মানুষ। যুদ্ধ করে দেশ পেয়েছি। কলেরা-ডায়েরিয়া মহামারি সামনে ফেলে সফল হয়েছি। করোনা-বন্যাকেও জয় করতে হবে। সব ভয়কেই দূরে সরিয়ে নির্ভয়ের বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের। বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ হলেও সব দুর্যোগ, মহামারি উৎড়ে সফলতার মুখ দেখেছে। উন্নত দেশের স্বাদ পাচ্ছি আমরা। সকল ভয়কে কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
এইচআর/পিআর