দেশজুড়ে

বেড়িবাঁধেই ঈদ তাদের

চলতি বছর দেশের নদ-নদীগুলোতে নির্ধারিত সময়ের আগেই বাড়তে শুরু করে পানি। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি জুলাইয়ের শুরুতে গড়ায় পদ্মা-যমুনার মিলনস্থল দেশের মধ্যাঞ্চলে। কিছুটা কমে আবারও বাড়তে বাড়তে প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ লোকালয়ে। ঈদ নিয়ে ভাবার আগেই হতে হয় ভিটেমাটি ছাড়া। মাসজুড়ে টানা ভোগান্তির ক্লান্তি নিয়ে ফরিদপুরের বানভাসি মানুষের ফিকে হয়ে আসা ঈদের ভাবনায় এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস।

Advertisement

সরেজমিন বন্যা উপদ্রুত কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চরাঞ্চল ও বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ গরু-ছাগলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বেড়িবাঁধ, হেলিপ্যাড ও আশ্রয়কেন্দ্রের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার বিভিন্ন কাঁচা-পাকা সড়ক। বাড়ি-ঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন উঁচু স্থানে গবাদি পশু ও পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।

চরভদ্রাসন সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গী গ্রামের ফারুক খান বলেন, প্রতি বছরই কোরবানি দেই, এ বছর বন্যায় সব ফসল তলায় গেছে। টাকা জোগাড় করতে পারি নাই। নিজেরাই কষ্টে আছি, কোরবানি দেয়া হবে না।

পাশের খালাসীডাঙ্গী গ্রামের কাঠব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর বলেন, একে তো করোনা তার ওপর বন্যা। কোরবানি দেয়ার উপায় নাই। ছেলে-মেয়ে নিয়্যা আগে বাইচ্যা নেই।

Advertisement

একই উপজেলার চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের চরকল্যাণপুর লস্করডাঙ্গী থেকে আসা দুটি পরিবারের সুখজান (৫০) ও নাছিমা আক্তারের (৪৫) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়িতে পানি ওঠায় জীবন বাঁচাতে ২৫ জুলাই ১৫টি গরু ও ৮টি ছাগল নিয়ে স্থানীয় হেলিপ্যাডে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনে দিনে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গো-খাদ্য সংকটের পাশাপাশি নানা সমস্যায় রয়েছেন তারা। ঈদের বিষয়টি তাদের মাথায় নেই।

পানিবন্দি পরিবারের বিষয়ে উপজেলার চার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানান, উপজেলার প্রায় সকল গ্রামসহ নদীর তীরবর্তী পরিবার ও বেড়িবাঁধের ভেতর-বাহির মিলে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।

চরভদ্রাসন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানা বলেন, সরকারিভাবে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত রয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে শুকনা খাবার, শিশুখাদ্যসহ ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মানুষদের সবরকমের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বন্যার্তদের মাঝে পানি রাখার ক্যান, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণের পাশাপাশি গোখাদ্য সংকট মোকাবিলায় তালিকা তৈরি করে খুব শিগগিরই সহায়তা প্রদান করা হবে।

সবসময় দুর্গত মানুষের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে তিনি আরও বলেন, বন্যা দীর্ঘমেয়াদে হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র, উঁচু স্থান ও বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোকে সেখানেই হয় তো পার করতে হবে কোরবানি ঈদের সময়টা।

Advertisement

জেলা সদরের নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত রোকেয়া বেগম বলেন, বন্যার পানিতে সবকিছু তলিয়ে গেছে। আশ্রয় নিয়েছি আশ্রয়কেন্দ্রে। আমাদের আবার ঈদ? সবকিছু ভুলে গেছি। ঠিক মতো খেতেই পারছি না।

জেলার সদরপুর উপজেলার চরনাছিরপুর বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেয়া আশরাফ মন্ডল বলেন, বন্যার কারণে বেড়িবাঁধে এসে উঠেছি। প্রতি বছর বাড়িতে পশু কোরবানি দেই। এ বছর আর দেয়া হবে না। ঈদের দিন বেড়িবাঁধেই কাটাতে হবে।

জেলার সাত উপজেলায় এখন পর্যন্ত ৫৫০টি গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। বন্যায় এখন পর্যন্ত আট হাজার ১৬৭ হেক্টর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে গেছে ৪০ মিটার। রাস্তা ভেঙে গেছে এক হাজার ৪০০ মিটার। ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই হাজার ৫৬৮ জন মানুষ এবং এক হাজার ৩৪৪টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া বেড়িবাঁধে দুই হাজার ২৫০ জন মানুষ এবং ৪০০ গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। গঠন করা হয়েছে ২৫টি মেডিকেল টিম।

এদিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকারের নির্দেশে পবিত্র ঈদুল-আজহার আগেই ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। গতকাল বুধবার (২৯ জুলাই) সকাল থেকে শুরু হয় এ কার্যক্রম।

জেলা প্রশাসকের দিকনির্দেশনায় জেলা সদরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপক কুমার রায়, চরভদ্রাসন উপজেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা ও সদরপুর উপজেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল কবির ত্রাণ বিতরণ করেন।

এ সময় প্রত্যেক উপজেলার নির্বাহী অফিসার, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদে কর্মরতরা উপস্থিত থেকে ত্রাণ প্রদান কার্যক্রমে সহায়তা করেন। ঈদ সামনে রেখে চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ত্রাণ প্রদান করা হয়। কেরোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর গত পাঁচ মাস ধরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় প্রতিদিনই চলছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম।

 

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে জেলায় ৫৫০ মেট্রিক টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া জেলায় চার লাখ টাকার শিশুখাদ্য, আট হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এর বাইরে জেলায় নিয়মিত গোখাদ্যও প্রদান করা হচ্ছে।

 

শুধু ত্রাণ বিতরণ নয়, চরাঞ্চলের জনগণের জন্য প্রদান করা হচ্ছে শুকনা খাদ্যসামগ্রী, পানির ক্যান, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট। বিভিন্ন বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে আগতদের মাঝে রান্না করা খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে নিয়মিত। শিশুদের জন্য আলাদাভাবে নিয়মিত পুষ্টিকর শিশুখাদ্য দেয়া হচ্ছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকার নারী ও কিশোরীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে বিশেষ স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী (স্যানিটারি ন্যাপকিন)। বেসরকারি একটি সংস্থার মাধ্যমে এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে।

 

ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, বন্যা ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আসন্ন ঈদে যেন কোনো রকমের সমস্যা না হয় সেদিকে জেলা প্রশাসন সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।

বি কে সিকদার সজল/এমএআর/পিআর