বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩০ জুলাই। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই কমিটি গঠিত হয় সংগঠনটির। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুই বছর অতিক্রম করেছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সম্মেলনের দাবি তুলেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ নেতারাই।
Advertisement
২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের প্রায় দুই মাসের মাথায় কমিটি ঘোষণা করা হয়। তাতে সভাপতি হয় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক হয় গোলাম রাব্বানী। নেতৃত্ব পাওয়ার ১০ মাস পর ২০১৯ সালের ১১ মে তারা ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা করে।
একই বছর ১৪ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে পদচ্যুত হয় তারা। তারপর কেন্দ্রীয় কমিটির ১ নম্বর সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও ১ নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য পদাধিকার বলে যথাক্রমে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়।
এর পরের বছর ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সভায় তাদের দু’জনকে ভারমুক্ত করার প্রস্তাব দিলে আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদেরকে ভারমুক্ত করেন।
Advertisement
কিন্তু ভারমুক্ত হওয়ার পরও সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য পদচ্যুত সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীর একই পথে হাঁটা শুরু করেন। তাদের বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা নেতাদের দায়িত্ববণ্টন, জেলা কমিটি প্রদান না করা, কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতাসহ নানা অভিযোগ উঠে। কিন্তু তারা বিভিন্ন ইস্যু দেখিয়ে এসব বিষয় কৌশলে এড়িয়ে চলে।
খোঁজ জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ১১১টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে ১০৮টি কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। শোভন-রাব্বানী থাকাকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করে। আর জয়-লেখক কোনোপ্রকার সম্মেলন ছাড়াই প্রেস রিলিজের মাধ্যমে নড়াইল, চাঁদপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটি ঘোষণা করে।
এর মধ্যে শোভন-রাব্বানীর দেওয়া দুইটি কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নানা কারণে বহিষ্কার হওয়ার পর সেখানে দায়িত্বপালন করা ভারপ্রাপ্তদের ভারমুক্ত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
জয়-লেখক কমিটি দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বারবার বললেও তারা তা করেনি। এছাড়া গত এক বছরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো সাধারণ সভা হয়নি। শুধু প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। সম্মেলন ছাড়াই তিনটি জেলা শাখায় কমিটি ঘোষণা করে।
Advertisement
এসব প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অনেক সময় ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের জরুরি সিদ্ধান্ত মোতাবেক’ উল্লেখ করা হলে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা তা জানে না। তাদের দু’জনের (জয়-লেখক) সিদ্ধান্তকে দলীয় সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেছে কেন্দ্রীয় অনেক নেতা।
এছাড়া করোনা ও বন্যার সময় বিভিন্ন জেলায় কাজ করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দায়িত্ব দেওয়া হলেও এ বিষয়ে পূর্বে তাদেরকে কিছু জানানো হত না এবং সেসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য কোনোপ্রকার উপকরণ না দেওয়ায় সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে বিব্রত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে।
দীর্ঘ হচ্ছে অভিযোগের তালিকা
সংগঠনের দায়িত্ব, শৃঙ্খলা ও অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার কারণে ১টি জেলা, ৫টি উপজেলা, ২টি থানা ১টি পলিটেকনিক ও একটি কলেজের কমিটি স্থগিত করেছে এই কমিটি। অভিযোগ আসার কারণে ২টি জেলা, ২টি উপজেলা, ৩টি থানা ও ১টি পৌর কমিটির বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নতুন কমিটি প্রদান না করে ২টি জেলা, ৪টি উপজেলা, ১টি কলেজ ও ১টি পলিটেকনিক কমিটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে এই কমিটি।
৩০১ সদস্যের কমিটির ৩৫ জনই বহিষ্কৃত
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের ৩০১ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে শোভন-রাব্বানী। কমিটি করার ১ বছরের মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে প্রথমে কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে পদচ্যুত করেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বিতর্কিত ৩২ নেতাকে অব্যাহতি ও তাদের পদ শূন্য ঘোষণা করে।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগে আটক হওয়া কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম মুমিনকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। এসব পদের মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পদাধিকার বলে পূরণ হলেও ৩৫টি পদ শূন্যই রয়ে যায়। এসব শূন্য পদ পূরণ করার অঙ্গীকার গণ্যমাধ্যমে একাধিকবার করলেও তারা তা পূরণ করেনি।
এই ৩৫ জনের বাইরেও আরও সাত-আটজন নেতা ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি চেয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়।
নতুন সম্মেলনের পক্ষে যুক্তি কেন্দ্রীয় নেতাদের
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অল্পকিছু নেতা ছাড়া বাকি সবাই সম্মেলন দাবি করে এর পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। তাদের দাবি, বর্তমান ছাত্রলীগের কমিটি অকার্যকর। তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা নেই। ভাগ্যগুণে নেতা হওয়ায় তারা কীভাবে কী করতে হয় জানে না।
এছাড়া বর্তমান কমিটির শীর্ষ পদের দু’জনকেই নেতা হিসেবে তারা মানতে পারছে না। তারা প্রতিবেদককে বলছে, তারা আমাদের কলিগ। তারা আমাদের নেতা হতে পারে না। যদিও তারা শীর্ষ পদ লাভ করেছে তবুও তাদের মধ্য থেকে কলিগ থাকার যে মানসিক প্রবণতা ছিল তার পরিবর্তন হয়নি। তারা আমাদের কমিটিকে তাদের প্রতিযোগী ভাবছে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সোহান খান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের বাহক। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের জন্য বর্তমানে এই সংগঠনটি প্রাণ হারিয়েছে। যে কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুর্নীতির দায়ে পদচ্যুত হয়েছে।
এছাড়া এই কমিটির আরও ৩৩ জন নেতা বহিষ্কৃত ও অব্যাহতি প্রাপ্ত হয়েছে। এই কমিটি ছাত্রলীগের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। আমরা এই নতুন সম্মেলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে চাই।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর আমাদের এখনও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টুঙ্গিপাড়ায় সমাধিস্থলে ফুল দিতে নিয়ে যায়নি। আমাদের কমিটিতে থাকা নেতাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারেনি। তারা তাদের দু’জনের সিদ্ধান্তকে দলীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে। যা কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এসব অভিযোগের জবাবে জাগো নিউজকে বলেন, আমরা খুব কঠিন সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দায়িত্ব পেয়েছি। শুরু থেকে আমরা সবকিছু গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সমস্যা থাকার কারণে এসব করতে পারেনি। এ বছরের এপ্রিলের দিকে বিভিন্ন কমিটি করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তা প্রদানের পরিকল্পনা নিলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়ে করা সম্ভব হয়নি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেব।
সম্মেলন হওয়া ইউনিটগুলোর কমিটি না হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এই সম্মেলন আগের নেতারা করে গেছেন। আমরা চাচ্ছি সেখানে কমিটি দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেসব ইউনিটগুলো খুব সিনসেটিভ হওয়ার কারণে এমনিতেই দিতে পারছি না।
কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বিভিন্ন অভিযোগের সমালোচনা করে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, আমাদের যোগ্যতা আছে বলেই আমাদের অভিভাবক দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদেরকে এখানে বসিয়েছেন। আমরা তার সিদ্ধান্ত মেনে চলেই সব কাজ করে যাচ্ছি। যারা আমাদের কাজের সমালোচনা করছে এবং যারা আমাদের ভাগ্যগুণে নেতা হয়েছি বলে মন্তব্য করছে তারাই অনুপ্রবেশকারী। আমি ছাত্রলীগের গত সম্মেলনে পদপ্রার্থী ছিলাম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদপ্রার্থী ছিলাম। কারো অনুগ্রহে নয় যোগ্যতা বলেই নেতা হয়েছি।
সম্মেলনের বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি জাগো নিউজকে আরও বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ অভিভাবক দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যখনই সম্মেলনের জন্য নির্দেশ দেবে আমরা তখনই সম্মেলন করব। প্রধানমন্ত্রীর কথার বাইরে আমরা যাব না।
এমআরএম