মায়মুনা লীনা
Advertisement
দিন যত যাচ্ছে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসের থাবা ততই ভয়ানক হয়ে বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করছে। টেস্টের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। সূত্র ধরে বাড়ছে আতঙ্ক আর উদ্বেগ। এ উদ্বেগ-আতঙ্কের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মম আচরণ দায়ী।
করোনার মতো একটি প্রাণঘাতী মহামারির সময় আমরা দেখলাম এ দেশের কিছু মানুষ কতটা অমানবিক হতে পারে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকতা, রিজেন্ট হাসপাতালের মো. সাহেদ, জেকেজির সাবরিনা চৌধুরী, সাহাবউদ্দিন মেডিকেলের কর্মকর্তারা সরকারের যতটুকু অর্জন ছিল তাও প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে। এ অপকর্মের হোতাদের সঙ্গে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী রাজাকার-আলবদর ও আল-শামসদের কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিকভাবে এসব অপরাধীকে বয়কট করা উচিত। তবেই সঠিক বার্তাটি যাবে এ ধরনের অপরাধীচক্রের কাছে।
দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের একাংশের দায়িত্বহীনতা ও তার সূত্র ধরে যে নগ্নবাণিজ্যের থাবা লক্ষ করা গেছে তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। দেশের স্বাস্থ্যখাত ও সরকারি হাসপাতালের ওপর অধিকাংশ জনগণের আস্থাহীনতার কারণে অনেকেই করোনা সংকটে নিজের মতো করে লড়াই করছেন। কিন্তু এটি আমাদের জন্য শুভলক্ষণ নয়। করোনার মতো একটি মহামারির সময় মানুষ সরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না কেন, সেটি আমাদের পর্যালোচনা করা দরকার।
Advertisement
শুধু অপরাধীদের রিমান্ডে নিয়ে বা পদধারীদের সরিয়ে এ অবস্থার অবসানের চেষ্টা না করে সংকট মোকাবিলার স্থায়ী কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। সে জন্য স্বাস্থ্যখাতকে একটি শক্তিশালী ছাতার নিচে আনতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের আওতায় রাখতে হবে। তাতে করে সমস্যাটি কমার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সমস্যা মোকাবিলার দ্বার উন্মোচিত হবে।
এটা সত্যি যে, দেশের মানুষের চলাচল ও প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হবে করোনাকে কেউই গ্রাহ্য করছেন না। এর কারণ হলো মানুষের জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা। প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের যে চাহিদা সেটা পূরণ করার জন্য সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে লড়াই করতে হচ্ছে বলে করোনা বিপদেও মানুষ ছুটে তার লক্ষ্যপানে ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মানসিকভাবে প্রত্যেকেই এবং পরিবারের সবাই আতঙ্কে ভুগছেন। একসময় যারা বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করতেন তারাও এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। সরকারিভাবে একেকসময় একেকরকম সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।
করোনাকালীন জাতীয় কমিটির সুপারিশ উপেক্ষিত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য রোগী নিয়মিত বা প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে না। ভর্তি হতে গেলে পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়। অনেক অপারশেনের রোগী অপরারেশন করাতে পারছেন না। চিকিৎসকরা অনলাইনে রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। ফলে অনেক গুরুতর রোগী সমস্যায় ভুগছেন। করোনা মোকাবিলায় দায়িত্বহীনতার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এসব আমাদের মতো একটি দেশের জন্য সুখকর নয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন করোনা মোকাবিলা করে দিনে দিনে সহনীয় অবস্থানের পথে যেতে পেরেছে সেখানে আমাদের সমন্বয়হীনতায় পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। করোনা মোকাবিলায় সরকারিভাবে উদ্যোগের অভাব না থাকলেও কেন সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে তার পূর্বাপর বিশ্লেষণ আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে এ ধরণের সংকট আবার তৈরি হলে আমরা তা সামাল দিতে পারব না।
Advertisement
আজ আমাদের শুধু চিকিৎসার দিকে নজর দেয়া যথেষ্ট নয়, একইসঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে করোনারোধ সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও গুণমানের দিকেও। বাজারে যেসব করোনারোধ সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো যথাযথ মানসম্পন্ন নয় বলে গণমাধ্যমে অসংখ্য রিপোর্ট এসেছে। সেসব রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কিছু পরিবর্তন সম্ভব।
একদিকে করোনার বিস্তার, অন্যদিকে বন্যার থাবা। এর সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। তিনটি বিষয়কে মাথায় রেখে সে অনুযায়ী কঠোরতা আর সতর্কতা এ মুহূর্তে খুব প্রয়োজন। ঈদ উদযাপন করতে গিয়ে যাতে করোনার বিস্তার না ঘটে সেটি নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। একইসঙ্গে বন্যা মোকাবিলায় সরকারের যে সহযোগিতা তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে হবে।
বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্যসহায়তা যেমন জরুরি, তেমনি শক্তিশালী চিকিৎসাব্যবস্থাও প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সরকারের কঠোরতা অবশ্যই দরকার। একইসঙ্গে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণকেও তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
এইচআর/জেআইএম