চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু করেছে সরকার। প্রথম ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে প্রয়াত প্রতিরক্ষাসচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী এবং সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক মো. মঈন উদ্দিনের পরিবার।
Advertisement
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সোমবার (২৭ জুলাই) উভয় পরিবারের নামে ৫০ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি টাকা মঞ্জুরি দিতে দুটি আলাদা চিঠি পাঠিয়েছে একই বিভাগেরই প্রধান হিসাব কর্মকর্তার কাছে। অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফ স্বাক্ষরিত উভয় চিঠিতে বলা হয়েছে, তাদের স্ত্রীদের কাছে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করবেন অর্থ বিভাগের ড্রইং অ্যান্ড ডিসবার্সিং অফিসার (ডিডিও)।
চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেটে ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি বাবদ ক্ষতিপূরণের জন্য বিশেষ অনুদান’ খাতে যে ৫০০ কোটি টাবা বরাদ্দ রয়েছে, তা থেকে এ ব্যয় করা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এ দু'জনের পরিবারকে দেয়ার মধ্য দিয়েই শুরু হচ্ছে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কার্যক্রম। প্রথমে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এরপর যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।
Advertisement
জানা গেছে, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিনজনের শরীরে শনাক্ত হয় মরণব্যাধী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। শনাক্তের কয়েকদিন পরই ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার কয়েক ধাপে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করে। কিন্তু সাধারণ ছুটিতে ও এর পরবর্তী সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ মাঠপর্যায়ের কর্মীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ গ্রেডভেদে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পাবেন। আর মারা গেলে পাবেন ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে গত ২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ‘করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ এ সংক্রান্ত সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারী দায়িত্ব পালনকালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরাসরি আর্থিক সুবিধা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
ওই পরিপত্রে আরও বলা হয়, ২০১৫ এর বেতন স্কেল অনুযায়ী, ১৫-২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন পাঁচ লাখ, মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ১০-১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন সাড়ে সাত লাখ এবং মারা গেলে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। এছাড়া প্রথম-নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ এবং মারা গেলে ৫০ লাখ টাকা।
Advertisement
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু বীমার ক্ষেত্রে সরকারকেই প্রিমিয়াম দিতে হবে। এছাড়া বীমার টাকা পেতে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই মাঠপর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে-
>> করোনাভাইরাস পজিটিভের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীসহ মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনাভাইরাস পজিটিভের প্রমাণ বা মেডিকেল রিপোর্টসহ নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট ফরমে ক্ষতিপূরণের দাবিনামা জমা দেবেন।
>> করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফরমে মৃত্যুবরণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্ত্রী/স্বামী/সন্তান এবং অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে বাবা/মা ক্ষতিপূরণের দাবি-সংবলিত আবেদন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবেন।
>> নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্রসমূহ যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মাধ্যমে অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠাবে।
>> প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারীরা কেবল এ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য হবেন।
>> ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সৃজনকৃত খাতে করোনা (কোভিড-১৯) সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় ক্ষতিপূরণ বরাদ্দকৃত অর্থ হতে নির্বাহ করা হবে। অর্থ বিভাগ ক্ষতিপূরণের আবেদনপ্রাপ্তির পর ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদানের সরকারি আদেশ জারি করবে।
>> এ ক্ষতিপূরণ বর্তমানে প্রচলিত অন্য যেকোনো প্রজ্ঞাপন/আদেশে বর্ণিত কর্মকালীন মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর্থিক সহায়তা বা অনুদানের অতিরিক্ত হিসেবে প্রদেয় হবে। চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে এ পরিপত্রের নির্দেশনা কার্যকর হবে।
জানা গেছে, গত ৫ এপ্রিল চিকিৎসক মঈন উদ্দীনের করোনা পজিটিভ আসে। অবস্থার অবনতি ঘটলে ৭ এপ্রিল তাঁকে সিলেট নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আইসোলেশনে রাখা হয়। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে পরিবারের সিদ্বান্ত অনুযায়ী তাঁকে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান। এরপর তার স্ত্রী চিকিৎসক চৌধুরী রিফাত জাহান ক্ষতিপূরনের জন্য আবেদন করেন। এ প্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণ নেওয়ার রিফাত জাহানেরর নিকট চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এদিকে প্রয়াত সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী মারা যান গত ২৯ জুন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। চিকিৎসা নিচ্ছিলেন বাসায়। পরে তাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। সেখানে তার করোনা শনাক্ত হয়। দুই সপ্তাহ ধরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকার পর মারা যান। ক্ষতিপূরণ নেওয়ার চিঠি পাঠানো হয়েছে তাঁর স্ত্রী গুল সাকিনা পারভীনকে।
এমইউএইচ/এনএফ/জেআইএম