ভ্রমণ

পর্যটন উদ্যোক্তারা কেমন আছেন?

মৌলভীবাজারে শীতকালের চেয়ে পর্যটক বেশি হয় বর্ষাকালে। বৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে চা, রাবার বাগান আর সবুজে ঘেরা জেলার প্রতিটি বাক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাশাপাশি হামহাম, মাধবকুণ্ডসহ জেলার ঝরনাগুলো যৌবন ফিরে পায় বর্ষায়। পর্যটকদের বড় একটি অংশ আসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেন্দ্রীক বিভিন্ন ট্যুর গ্রুপের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিবছরের চেয়ে ব্যতিক্রম এ বছরের পর্যটন খাত। করোনার কারণে পর্যটক শূন্য। ফলে বেকার এ খাতের হাজারও উদ্যোক্তা।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে দেশের স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। বিদেশি পর্যটক এসেছিলেন ৭-৮ লাখের মতো। এদের বেশিরভাগের পছন্দের তালিকায় ছিল টাঙ্গুয়ার হাওর, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডসহ পাহাড়ি এলাকার ঝরনা। কিন্তু এ বছর করোনার কারণে পর্যটনস্পট বন্ধ থাকায় এবং স্বাস্থ্য সচেতনার কারণে পর্যটকরা বের হচ্ছেন না। সে কারণে বেকার হয়ে কঠিন সময় পার করছে বিভিন্ন ট্যুর গ্রুপ। কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে ই-কমার্স শুরু করলেও সামান্য সময়ে নতুন ব্যবসা জমে উঠছে না। ফলে বিকল্প উপায়েও আয়ের পথ তৈরি হচ্ছে না। ট্যুরিজম বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।

ট্যুর গ্রুপ বিডির (টিজিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরানুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১৪ থেকে আমরা এ সেক্টরে আছি সুনামের সাথে। কিন্তু কখনো এত কঠিন অবস্থায় পড়িনি। প্রতি সপ্তাহে আমাদের গড়ে ৪টি ট্রিপ থাকে। প্রতি ঈদে এবং সরকারি ছুটিতে আলাদা করে ১০-১২টা ট্রিপ হয় একসপ্তাহেই। করোনার শুরুতে ২৬ মার্চের ছুটিতে আমাদের দশের বেশি ট্রিপ ছিল, সেগুলোও হয়নি। সেই হিসেবে কুরবানির পর ৬০-৭০টি হওয়ার কথা। এটি আমাদের জন্য এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় অপূরণীয় ক্ষতি। প্রতিটি ট্রিপেই গড়ে ১-৩ লাখ টাকার আর্থিক লেনদেন হয়। এ লেনদেনের সাথে পরিবহন, কৃষি, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, লোকাল গাইডসহ অনেক কিছু জড়িত থাকে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কিছু স্থাপনা আছে বিভিন্ন ট্যুরিজম স্পটে। সাজেক, সেন্টমার্টিন, শ্রীমঙ্গল, কক্সবাজারে আমাদের রিসোর্ট আছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী নৌকা আছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় সবগুলো স্থাপনাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এগুলো দেখাশোনা করতেও প্রচুর টাকা ব্যয় হচ্ছে। সব মিলিয়ে আপাতত দুরাশার মধ্যেই আছি। গত মাসে একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম শুরু করেছি। তবে এটি লাভবান পর্যায়ে আসতেও বছরখানেক লাগবে। ৫ মাসের অফিস ভাড়া দিচ্ছি, অফিস স্টাফদেরও স্যালারি দিচ্ছি বসিয়ে রেখেই। দ্রুত এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।’

Advertisement

ঢাবি থেকে মনোবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার শেষ করে ট্যুর গ্রুপ চালু করেন মোহাম্মদ সামছুল আরেফীন। লালন সিদ্দিকী, আরিফুজ্জামান, মেরী প্রিয়াংকা, কাউছার পলাশদের নিয়ে ‘গ্রুপ ডি ম্যাডভেঞ্চারস’ গ্রুপ খোলেন। করোনা আসার আগ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল। করোনার পর জব চলে যাওয়ার পাশাপাশি সব ট্যুরিস্ট স্পট বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনের পর থেকে বর্ষা পর্যন্ত ১০-১২টি ট্যুর দিতে পারতেন তারা। কয়েকশ মানুষ অংশগ্রহণ করতো। সেখানে ন্যূনতম ১২-১৫ লাখ টাকা লেনদেন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আয় বন্ধ হওয়ায় বর্তমানে তিনি ই-কমার্সের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। সামান্য আয়ে চলছে জীবন। ই-কমার্সে সফল না হলে আর্থিক সমস্যায় পড়বেন।

ভ্রমণকারী গ্রুপের পরিচালক সাব্বির খান বলেন, ‘চরম আর্থিক সংকটে আছি। করোনার কারণে কম করে হলেও ১৮-২০ লাখ টাকার ট্যুর দিতে পারিনি। বেকার হয়ে ই-কমার্স শুরু করেছি। অনলাইনে দেশি খাবার বিক্রির চেষ্টা করছি। নতুন কাজে যদি আগাতে না পারি, তাহলে মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হবে। এতে জীবনযাত্রা অনেক খারাপ পরিস্থিতির শিকার হবে। তাই অপেক্ষা করছি, যেন দ্রুত সময়টা কেটে যায়। আবারও সব স্বাভাবিক হয়।’

বাঙ্গাল ট্রাভেলার্সের অ্যাডমিন প্যানেলের সদস্য আসমা অধরা ও ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘আমরা শুরু করি ২০১৯ সালে। ভালোই সাড়া পাচ্ছিলাম। ২০২০ সালে আমাদের কিছু পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করোনা আসায় সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। অথচ মানুষের স্বাভাবিক জীবনের জন্য ঘোরাঘুরি প্রয়োজন। কিন্তু এখন ঘুরতে গেলে উল্টো স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। তাই সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। তবে আর্থিক যে ক্ষতি হয়েছে, তা পোষাণো সম্ভব নয়।’

বেঙ্গল ট্রেকার্সের পরিচালক শুন্য সাগর বলেন, ‘করোনার কারণে শুধু মার্চে ৫টি ট্যুর ক্যান্সেল করেছি। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত আমাদের ১৬টি ডোমেস্টিক ও ইন্টারন্যাশনাল ট্রিপ হওয়ার কথা ছিল। ঈদ উপলক্ষে ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ী ট্রিপ আরেঞ্জ হতো। সাথে আমাদের কর্পোরেট ক্লায়েন্টদের প্ল্যানগুলো ক্যান্সেল হয়ে যায়। তাই মার্চ থেকে জুলাই হিসাব করলে আমাদের প্রায় ২৫টি অফিসিয়াল ট্রিপ ক্যান্সেল হয়েছে। আনুমানিক সব মিলিয়ে সাড়ে ৪শ ক্লায়েন্টকে আমরা সার্ভিস দিতে পারতাম, যার টোটাল অ্যামাউন্ট ২৫ লাখ টাকা প্রায়। গত একমাস ধরে আমরা বিভিন্ন ট্র্যাভেল স্যুভেনির অনলাইনে সেল করছি। পাশাপাশি চাহিদার উপর ভিত্তি করে মধু আর ঘি সরবরাহ করছি। আমরা চাই, অন্য সেক্টরের মতো ট্যুরিজমকেও সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হোক। মনিটর করা হোক স্বাস্থ্যবিধি মেনে ট্যুরিজম হচ্ছে কি-না।’

Advertisement

ভ্রমণসংশ্লিষ্ট সংগঠন টোয়াবের পরিচালক মোহাম্মদ এ রউফ বলেন, ‘আমাদের সংগঠনে ৭ শতাধিক সদস্য রয়েছে। সবার ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ খাতের ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব।’

ঢাবির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভুঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্যুর অপারেটর, ক্ষুদ্র বা মাঝারি হোটেল মালিকদের চিহ্নিত করে আপদকালীন ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক থেকে কম সুদে জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটন খাতে চাকরিরতদের চাকরি যাতে না যায়, সেদিকেও সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। স্বল্প পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন চালু করে তা মনিটর করতে হবে। সেই সাথে সরকারি সব সহযোগিতা যতাযথভাবে দিতে হবে।’

এসইউ/এএ/পিআর