বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
Advertisement
পাখা দু’দিকে ছড়িয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো ও কলকাকলির দৃশ্য সবসময় ভীষণ মনোমুগ্ধকর। পাখির বাসা তৈরির অসাধারণ সৃজনশীলতাও যেন প্রকৃতির অপূর্ব স্থাপত্যশিল্পের বহিঃপ্রকাশ। কিছু পাখির বাসা নির্মাণশৈলী এতোটাই দারুণ যে, দেখে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটি ছোট্ট পাখি সুনিপুণ ও দক্ষ কারিগরের মতো শুধু তার ঠোঁট ও পায়ের নখ ব্যবহার করে কিভাবে এতো সুন্দর এবং নিখুত বাসা বানাতে পারে! তাই পাখির বাসা অনেক প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদের কাছে এক অপার বিস্ময়ের নাম।
মজার বিষয় হলো, পাখির বাসা শুধু সৌন্দর্য দিয়েই নয় বরং কিছু পাখির বাসা মানুষের রসনা তৃপ্তিতেও ভূমিকা রেখেছে। যেমন- চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াসহ কিছু দেশে সালাঙ্গান সুইফট পাখির লালা দিয়ে বানানো বাসার স্যুপ অত্যন্ত মূল্যবান এক উপাদেয় খাদ্যের স্থান দখল করেছে।
পাখির বাসা বানানোর কৌশল ও ধরন নির্ভর করে ওই বিশেষ এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান, গঠনগত প্রাকৃতিক বৈচিত্র ও উপাদানের উপরে। পাখিদের মাঝে কেউ কাদা দিয়ে, কেউ ডাল-পালা দিয়ে, কেউ ঘাস, খড়, বিচালি দিয়ে, আবার কেউ নিজের লালা ও গায়ের পালক দিয়ে বাসা বানায়। এসব বাসার গড়নও বিভিন্ন রকমের। কারো বাসা লম্বা চোঙার মতো, কারো বাসা সমতল, কারো বাসা ঝুড়ির মতো, আবার কারো বাসা গোলাকার।
Advertisement
পাখির বাসার দিকে ভালো করে তাকালেই বোঝা যায় যে এরা কত শ্রম, বুদ্ধি, ধৈর্য ও কৌশল খরচ করে একটি বাসা তৈরি করে। পাখিরা তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার সবটুকুই প্রয়োগ করে বাসা তৈরিতে। যাতে বাইরের কোনো বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করা যায়। জন্তু বা সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য অনেক পাখি বাসায় ঢোকার রাস্তা তলার দিকে করে। বাইরের আক্রমণকে আটকানোর জন্য তারা একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। সেটা হলো, অনেক সময় বাসার গায়ে আরও একটি গর্তের মতো মুখ তৈরি করে রাখে। সেটা কেবল ঠকানোর জন্য। তার ভেতর দিয়ে বাসার মধ্যে ঢোকা যায় না। তাহলে চলুন দেখে আসি পরিচিত কিছু পাখির বাসা-
গাছের পাতা সেলাই করে বানানো বাসা: দোলনার মতো দুলতে থাকা বাসা বানাতে টুনটুনি পাখি দুই থেকে তিনটি পাতা সেলাই করে ছোট্ট একটি বাটির মতো তৈরি করে। এর মাঝে নরম ঘাস-পাতা দিয়ে বাসাটি বানায়। সরু ঠোঁট দিয়ে চিকন কোনো লতা, তুলা, গাছের আঁশ বা ছন দিয়ে সেলাই করে বাসাকে মজবুত করে।
কোঠর, ফাঁক-ফোকর, হাঁড়ি-কলসির ভেতর বানানো বাসা: বাংলাদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল অন্য পাখির বাসায় হানা দিতে বেশ ওস্তাদ। এরা কাঠঠোকরা, টিয়া, বসন্তবৌরি ইত্যাদি পাখির বাসা দখল করে বাস করে, আবার নিজেরাও বাসা বানায়। এরা বাঁশের মাথার গর্তে, সুপারি গাছের গর্তেও বাসা করে। তা ছাড়া দালানের ফাঁক-ফোকরে, গাছের কোঠরে, ফেলে দেওয়া হাঁড়ি-কলসির ভেতরও বাসা করে। এদের বাসাটি বাটির মতো। আবার চায়ের কাপের মতোও হতে পারে। এ ছাড়া খড়ের গাদা, বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন পোল, দালানের ফাঁক-ফোকর, গাছের কোঠর, ভেন্টিলেটর, হাঁড়ি, কলসির ভেতরে চড়ুই, শালিক, ফিঙ্গে বাসা তৈরি করে।
গাছের গায়ে গর্ত তৈরি করে বাসা: কাঠঠোকরা সাধারণত ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মেরে গাছের গায়ে গর্ত তৈরি করে তার ভেতর বাসা বানায়। এরমধ্যে ঘাস, খড় দিয়ে বিছানার মতো তৈরি করে। কাঠঠোকরার বাসায় মাঝে মধ্যে ডিমের লোভে সাপ ও গুইসাপ হানা দেয়। তাই কাঠঠোকরাকে ঘন ঘন বাসা পরিবর্তন করতে হয়।
Advertisement
কাদা, ঘাস, লতা-পাতা দিয়ে বানানো বাসা: বাবুই খুব সুন্দর করে কাদা, ঘাস, লতা-পাতা দিয়ে শৈল্পিক বাসা বোনে বলে একে ‘তাঁতিপাখি’ নামেও ডাকা হয়। বাবুই তাল, নারকেল, খেজুর, সুপারি, রেইনট্রি গাছে দলবেঁধে বাসা বোনে। এদের বাসার গঠন বেশ জটিল আর আকৃতিও খুব সুন্দর। বাবুই পাখির বাসা দেখতে অনেকটা উল্টানো কলসির মতো। বাসা বানানোর জন্য বাবুই ভীষণ পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ও কাদার মিশ্রণ ঠিক করে। যত্ন করে পেট দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে গোলাকার অবয়ব মসৃণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিক বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা তৈরি করে। অন্যদিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ বানায়। বাবুই সাধারণত দুই ধরনের বাসা তৈরি করে। মজার বিষয় হলো, পুরুষ পাখি তার পরিশ্রম ও শৈল্পিকতার মিশ্রণে এসব বাসা তৈরি করে। একটি বাসা তৈরি হতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। শৈল্পিক নিদর্শনের এমন দারুণ সব বাসা বাতাসের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে মানুষের মনে আনন্দ দেয়।
গাছের ডাল দিয়ে বানানো বাসা: বড় বা মাঝারি গাছের মাথায় শুকনো ও কাচা ডাল-পালা দিয়ে বাসা বানায় ঈগল, চিল, পানকৌড়ি ও বক। মাঝে মধ্যে খড়, প্লাস্টিকের তার ঠোঁট, পায়ের নখ দিয়ে নিয়ে এসে বিছিয়ে দেয়। যাতে বাসা শক্ত এবং আরামদায়ক থাকে।
জলের ওপর ভাসমান বাসা: জলের ওপর নানা উদ্ভিদ যেমন- কচুরিপানা, শাপলা, পদ্ম, কলমি, হেলেঞ্চার ঝোপে খড়-কুটো, শুকনো পাতা, বাঁশের শেকড় ও পাতা, কচুরিপানার শেকড়, পাটের আঁশ, শ্যাওলা, পানির ঘাস দিয়ে বাসা বানায় ডাহুক, কালিম ও কিছু জলচর পাখি। অনেক সময় পানির স্রোতে কলমি বা কচুরিপানার সঙ্গে এসব পাখির বাসাও ভেসে যেতে থাকে।
মাটির গর্তের মধ্যে বাসা: মাটির গর্তের মাঝে বাসা বানাতে পটু হলো মাছরাঙা, কাদাখোঁচা, সুইচোরাসহ জলজ অনেক পাখি। এরমাঝে মাছরাঙা মাটির ঢালে, উঁইয়ের ঢিবিতে অন্য পাখির খোড়া গর্ত কিংবা গাছের পচা-গুড়ির ফোকরে বাসা করতে ভালোবাসে। স্ত্রী-পুরুষ পাখি উভয়েই ঠোঁট দিয়ে মাটি বা পচা কাঠ আলগা করে গর্ত খোড়ে এবং পায়ের সাহায্যে মাটি বা কাঠের গুঁড়া গর্তের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে বাসা তৈরি করে।
লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।
এসইউ/এএ/পিআর