ফিচার

হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক শব্দ!

সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য অঞ্চলের মতো মাগুরা অঞ্চল থেকে স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত অনেক শব্দ হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। সেই পুরোনো আমলের বা আমাদের ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত অনেক শব্দ এখন আর শুনতে পাওয়া যায় না। অনেক শব্দ আমরা দাদা-দাদি, নানা-নানি, মা-বাবার মুখে শুনলেও নতুন প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠছে অজানা-অচেনা। সংস্কৃতি ও জীবনাচারে পরিবর্তন এবং বস্তুগত উন্নয়নের কারণেই মাগুরায় পূর্বে ব্যবহৃত অনেক আঞ্চলিক শব্দের বিলুপ্তি ঘটেছে। যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন শব্দ।

Advertisement

জানা যায়, শিক্ষিত থেকে শুরু করে কৃষাণ-কৃষাণিও এখন নতুন নতুন শব্দগুচ্ছকে বরণ করে নিয়েছে। আশির দশকের শুরু থেকে আকাশ সংস্কৃতি চালু হলে গ্রামে নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার বাড়তে থাকে। একইভাবে পরবর্তীতে মোবাইল যুগে অবাধ প্রবেশের পর শুধু শহর নয়, গ্রামের মানুষের কাছেও প্রচুর নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার পরিচিত হয়ে ওঠে। অজপাড়াগাঁয়ের কৃষাণি বা একজন চাষির শব্দভান্ডার একসময় সীমিত হলেও মোবাইল আসার পর এখন ‘নেট’ শব্দটি খুবই পরিচিত। মোবাইল ফোনে কথা বলতে অসুবিধে হলে নিজেই বলে ওঠেন ‘নেট’ পাচ্ছে না বা নেটে সমস্যা। এমন শব্দচয়নেও এখন কারো সমস্যা হয় না।

একসময় আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ বয়স্কদের চলাচল ছিল সীমিত। ফলে তাদের শব্দভান্ডারের পরিধি বা আকার ছিল খুবই ছোট। কিন্তু সেই তারাও এখন ফেসবুক, ইন্টারনেট শব্দ বোঝেন। গ্রামের একেবারে লেখাপড়া না জানা মানুষটিও এসব শব্দের অর্থ বোঝেন। হালে চ্যানেল ও সিরিয়াল শব্দটি বোঝেন না-এমন লোক পাওয়া এখন মুশকিল। বর্তমানে গাঁয়ের মানুষের কাছেও মোবাইল, নেট, কানেকশন, মেসেজ, মেসেঞ্জার, ফেসবুক, ফ্লেক্সিলোড, এমবি, ডাউনলোড, ব্লুট্রুথ, শেয়ার, ইমো, হোয়াটসআপ, বিকাশ, ভাইবার, জুম, ভিডিও, লাইভ সবই সহজবোধ্য। এসব শব্দ এখন সবার মুখে মুখে। হালে ‘লকডাউন’ শব্দটি এখন সবার কাছেই পরিচিত।

কালের বিবর্তনেই পুরাতন শব্দকে পেছনে ফেলে নতুন নতুন শব্দ জায়গা করে নিচ্ছে। এর অন্যতম কারণ বাহ্যিক পরিবর্তন, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ শক্তির উন্মেষ। সম্প্রতি প্রযুক্তি আর যোগাযোগ কৌশলের পরিবর্তনের কারণেই যেন নতুন এক ভাষার উদ্ভব হয়েছে। মানুষ নতুন যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে বসবাস করছেন; সেখানেই সে যোগাযোগ কৌশলে বেছে নিচ্ছে নতুন নতুন শব্দ।

Advertisement

পুরাতন অনেক শব্দ হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো- শহরায়ন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তর। দেখা যাচ্ছে, গ্রামে বাহ্যিক নানা পরিবর্তনের ফলে আসবাবপত্রসহ বাড়িতে ব্যবহার্য অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। ফলে সেই নামগুলো ব্যবহার না হতে হতে হারিয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেমন ঘরবাড়ির কথাই ধরা যাক। একসময় গ্রামে ছিল মাটি ও ছনের তৈরি ঘর। কিন্তু এগুলো এখন বিলুপ্ত। সবখানেই এখন আধাপাকা বা পাকা বাড়ি। এই ঘর-বাড়ি কেন্দ্রীক কিছু শব্দের ব্যবহার ছিল গ্রামগুলোতে। আবার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেভাবে রাখা হতো; সেখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেই আগের মতো করে রাখা হয় না। এখন গ্রামেও সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না-বান্না হয়। ফলে এখানেও শব্দ ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে।

একইভাবে কিছু পেশা-প্রথাতেও পরিবর্তনের কারণে পুরোনো শব্দগুলো হারিয়ে গেছে বা তেমন একটা শোনাও যায় না। হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুঁজতে গিয়ে নিম্নোক্ত শব্দগুলোর খোঁজ পেয়েছি। তবে নিশ্চিত এর বাইরে আরও অনেক শব্দ রয়েছে। যেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে।

মাগুরা অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া বহুল ব্যবহৃত শব্দের একটি তালিকা (উচ্চারণ অনুযায়ী) এখানে উল্লেখ করা হলো-স্থানসংক্রান্ত: পালান, দুয়াল, দোপ, দোপা, পগাড়, মেটেল, হালট, নালা, পাওরি, কুম (বড় গর্ত), ডোবা, আড়া, গাড়া, জিয়ালা, পৈয়াম (সরু নালা), কানদি, কুয়ো, চাকলা, সিথেন (বিছানা)।

ঘর-বাড়িসংক্রান্ত: হাতনে, পতনে, ডুয়া, খুটি, লেপা, আড়া, ডাসা, হুড়কো, খোপ, চাঙ, চড়াট, খিল, বাটাম, রুয়ো, চৌকি, জলচৌকি, ডাফ, কানছি (ঘরের পেছনে)।

Advertisement

কৃষি ও চাষসংক্রান্ত: গোয়ারা, টেঙি, আচড়া, বেশই, মাথাল, টোনা, পাতো, ডেলা, কেন্দর, মলন, ঢেঁকি, চড়ুম, নোট (চিঁড়ে কোটার), খেটে, পাটসারা (ধান গোছানো হয়), জাব, গাদা (একসাথে), পালা (খড়ের পালা), বিচেলি (খড়), নাড়া (খড়), মশনে, মেস্তা, কাউন, ভুড়ো, বেছন, আগরা, আস্টেল, ভাটি, কুষ্টা।

জিনিস রাখা বা পাত্রসংক্রান্ত: ছিয়ে, অ্যাংলে (কাপড় রাখার জন্য ঝুলিয়ে রাখা তক্তা), মাচা, জালা, কোলা, খুঁটি, ঘট, মালশা, ঢাকুন, আদলা, ঘটি, সানকি, শরপেশ, চালন, ডোল, আউরি, ধামা, কাঠা, সের, খলুই, জের, ঠিলে, মটকা, ঝেঁঝোর, ডগি, কেইড়ে, বোচকা (জিনিসপত্রের ব্যাগ), টুপলা।

রান্নার কাজে ব্যবহৃত জিনিসসংক্রান্ত: ডেকচি, খাপরি, পেলে (পাতিল), হাতা (চামচ), অরোং, নাওরি, থাল, চালন, কুলা, পাটা, পুতো, আছাড়ি, ঘুটে, আহা (চুলা), ঝিক (মাটির চুলার সরু মাথা), খুচানি, কুড়ানি, উপো (ফুঁ দেওয়ার যন্ত্র)।

খাবারসংক্রান্ত: ছালুন (তরকারি), জাউ, ধাপড়া, দলো, ছিন্নী, উরুম (মুড়ি), বজা (মাছের ডিম), পিছা (মাছের অংশ বিশেষ), কুশোর (আখ), গুয়ো (সুপারি), থোড় (কলাগাছের ভেতরের অংশ), খুদ (চাউলে ভাঙা অংশ), ফ্যান (ভাতের মাড়)।

বাড়িতে ব্যবহৃত জিনিসসংক্রান্ত: শলা, গোঁজ, হেরিকেন, চিমনি, সলতে, পলতে, যাতা, গারু, ফিড়ে, সাজি।

দেশীয় অস্ত্রসংক্রান্ত: যুঁতি, এঁরা, কোঁচ, থোরকোঁচ, ছ্যান, ভেলা, শড়কি, উড়ো, ঢাল, ছেনি, বর্শা, ড্যাগার।

নৌকা ও মাছধরার যন্ত্রপাতিসংক্রান্ত: ঘুনি, দুয়ারি, বানা, উছা, হ্যাচাক, লগি, বৈঠা, চরাট, ডাওত, গলুই, গুন, পাটাতন, ছই, পাল, ডুঙা, পেনেট (চটা পানিতে ভিজিয়ে রেখে করা হয়), হাইল।

অন্য শব্দ: হ, ছুরানি, লেম্ফো, কুপি, ডলক (বৃষ্টি), জার (শীত), কাঁচড়া (কাঁচা), ভাড়াসে (অসময়ে), বাসনা, কারা (হাটে কারা দেওয়া), বীরে (মাথায় কোনো ভারি বোঝা বা বস্তু নেওয়ার আগে যেটা ব্যবহার করা হয়), কোচ, তবিল, হাবড়, নিজেল, ঝিনে, আহালি (চাউলের মধ্যে যেটা খাবারের অযোগ্য শক্ত বস্তু বিশেষ), মালগোছা (বিশেষ কায়দায় লুঙ্গি কোমরের সাথে বাঁধা), দরাম (জোরে), ফস (তাড়াতাড়ি), ফাঁসা (জানালা, বেড়া বা হাতের ফাঁক), জিয়াফত (দাওয়াত খাওয়া), ফসাৎ (হঠাৎ), নাওয়া (গোসল), ডাক (বজ্রপাতের শব্দ), আবলোস (বোকা), চাটাম (বেশি করে বলা), হিয়েল/ইয়েল (কুয়াশা), ওজোর (জেদ), ফোরন (কথার মধ্যে কথা বলা), ভরো (পিছিয়ে পড়া গ্রাম), গফাৎ (হঠাৎ পড়ে যাওয়া), অশোলে (বিরক্তি কথা), শলক (সকাল), এঁটে (অপরিষ্কার হাত), রুল (লাঠি), হাউস (শখ), আঁচা (নারকেলের আঁচা), হাবু (গোসল), আললে (লবণহীন তরকারি), আঁশটেল (একধরনের কচ্ছপ), ঝুল (ঘরের ময়লা), ছ্যামা (ছায়া), আজাড়ে (অমূলক), আবাইতে (দ্রুত খাওয়া), হাবলা (বোকা), ঢল (বৃষ্টি), আজদাহা (আজদাহা টাইপের মেয়ে), আটাচালা (চালন), আটালু (গরুর গায়ে থাকা পোকা), আটো (ছোটঘর, চেপেধরা পোশাক), আটখুড়ো (যার সন্তান নেই), এঁরো (বাঁকা কথা), কান্টে (যে ঝগড়া করে), আড় (কাপড় শুকানোর জন্য টানানো বাঁশ), কাতিকুতু (কুতু দেওয়া, হাসানো), আধলা (অর্ধেক), আদার (বড়শির টোপ), সেয়ানা (বয়স্ক ছেলে-মেয়ে), কোচ (কামিজ বা লুঙ্গিতে কিছু রাখার কৌশল), আনা (এক আনা, দুই আনা), নুন (লবণ), ছ্যাপ (থুথু), ফায়না (শখ), আইরপথ (অন্যপথ), আলোপাতা (তামাকপাতা), গচি (ছোট বাইন), ইচা (চিংড়ি মাছ), ইট্টুজালা (ছোট), ঈষ (লাঙলের অংশ), উদা (নরম হয়ে গেছে)।

ইট্টু (ছোট), বলগ (ভাতে গরম হওয়া), আন্ধাররাইত (মধ্যরাত্রি), ক্ষার (জামা-কাপড় পরিষ্কার করা), ব্যালক (সংসারে আলাদা হওয়া), বাটকে (খাটো), দর (গত করা), নেতি (নরম কাদা), ঠিসে (পিপাসা), আতর (জমির চাষের পরিমাণ), খুপি (গোপন ছোট জায়গা), মিতে (বন্ধু), খিজি/খিজালত (যন্ত্রণা করা), কল (টিউবওয়েল), চ্যাঙা (ছোট ডালের লাঠি বিশেষ), কিলিক (ষড়যন্ত্রকারী), চুঙো, ঠুসি, জুঁত (ঠিকমতো), চাড়া, চাবলা, চেলে, কাঁকর (বাঙি), খ্যাতা (কাথা), খাবলা (একমুঠ), গবদা (মোটা), টাটি (টয়লেট), ফুলো (অপরিপক্ক), উলোফা (বাজে কথা), উয়ালে (আবর্জনা), শান (ইটের মেঝে), মুথা (গাছের গোড়া), উবধো (নিচু হয়ে দেখা)।

কাববি (রগড়), বুকতা (অকার্যকর), কতকত (দ্রুত), কচা (কেউ ক্ষতি করবে এমন), কটাশ (কামড়ে খাওয়া), কটকটে (মুখে মুখে কথা বলে যে), করাৎ (দ্রুত কিছু করা), কাইমাই (ঝগড়াঝাটি), কামকুম (কাজ সারা), কামানো (ক্ষৌরিকর্ম), জিবুত (কমবয়সী ছেলেমেয়ে), উজ্জ্বতি (ঝগড়া করা), পিল­ামেনে (দেখতে বড়), ভরাপড়া (ক্ষতি করতে এসেছে এমন কেউ), উদবেশে (অস্থির লোক), গিরিফিনটি (কথিত বুদ্ধিমান), কুয়ে (পচা, জটিল), ক্যাতরা (দুর্বল), ভরো (গ্রাম্য), ফ্যাদা (অতিরিক্ত কথা), ক্যাটাং (হাস্যরস করা)।

এসব শব্দ এখন অনেকটাই ব্যবহার করা হয়। একসময় হয়তো পুরোটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার স্থানে জায়গা করে নেবে নতুন নতুন সব শব্দ।

মো. আরাফাত হোসেন/এসইউ/এএ/এমএস