ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নাম পরিবর্তন করা রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টদের কেউই।
Advertisement
এ বিষয়ে ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, নাম সংশোধনে যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করেই তারা এটি করেছেন।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনু বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, একজন নাগরিকের নামের অতিরিক্ত অংশ সংশোধনে যে ধরনের দলিল-দস্তাবেজ প্রয়োজন, তার সবই চাহিদানুযায়ী জমা দেয়া হয়েছে এবং এর আলোকে সংশোধন করা হয়। কমিশনের এনআইডি উইংয়ে জমা দেয়া তথ্য যাচাই করে গরমিলের কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। তবে উচ্চতর ডিগ্রির সনদটিতে তথ্য গোপন করেছিলেন কি না সেটিও খতিয়ে দেখছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নাম সংশোধন করে ‘সাহেদ করিম’ থেকে হয়েছেন ‘মোহাম্মদ সাহেদ’। তার এনআইডি স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন।
Advertisement
এ বিষয়ে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর বলেছিলেন, ‘সাহেদের নাম পরিবর্তন জালিয়াতির সঙ্গে ইসির কারা জড়িত, খুঁজে বের করতে তদন্ত চলছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রমাণসাপেক্ষে সাহেদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জানা যায়, মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সাহেদ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এই পরিচয়পত্রের নাম পরিবর্তন করেছেন। সাহেদের আসল নাম সাহেদ করিম, বাবার নাম সিরাজুল করিম, মা- মৃত সুফিয়া করিম। কিন্তু এখন তিনি যে এনআইডি ব্যবহার করছেন, সেখানে তার নাম মোহাম্মদ সাহেদ। ২০০৮ সালের ২৫ আগস্ট সাহেদের নামে যে জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়েছিল, তার নম্বর ছিল ২৬৯২৬১৮১৪৫৮৮৫। আর এখন তার নামে থাকা স্মার্ট এনআইডির নম্বর ৮৬৫০৪০৬১৮৭।
সাহেদ ২০১৯ সালে তার এনআইডি সংশোধন করার সময় জন্মনিবন্ধন, নাগরিকত্ব সনদ, পাসপোর্টের কপি এবং ‘ও’ লেভেলের সার্টিফিকেট জমা দেন। এনআইডির তথ্য সংশোধনে তার নাম সাহেদ করিম থেকে মোহাম্মদ সাহেদ হয়। অথচ এখন জানা যায় তিনি এসএসসি পাস।
কিন্তু নতুন এনআইডি প্রদানকারীদের ব্যাখ্যা হলো, মোহাম্মদ সাহেদ করিম থেকে মোহাম্মদ সাহেদ নামে পরিচয় সংশোধনের জন্য যে ধরনের তথ্য দরকার তা বর্তমানে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি সবই জমা দিয়েছিলেন। এছাড়া মূল নাম পরিবর্তন না করায় ইসির এক্ষেত্রে সংশোধন নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।
Advertisement
জানা যায়, বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে, এতে এনআইডির একজন পরিচালককে আহ্বায়ক করে সংশোধন সংক্রান্ত টেকনিক্যালসহ সব শাখার কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে কমিশন।
কমিটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘পরিচয়পত্র সংশোধনে জন্মনিবন্ধন, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্টের ফটোকপি ও শিক্ষা জীবনের সনদও জমা দেন সাহেদ। তবে উচ্চতর ডিগ্রির সনদ যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় এর সত্যতা বিবেচনায় (অন্যান্য প্রমাণাদি) তার পরিচয়পত্র সংশোধন করা হয়। কারণ তিনি মূল নাম সংশোধন করেননি, নামের অতিরিক্ত অংশটি ছেঁটে ফেলতে আবেদন করেছিলেন। এ ধরনের সংশোধন সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সংশোধন করা হয় এবং হচ্ছে। ইসি একটা সেবামূলক সংস্থা তাই মানবিক দিকগুলোও বিবেচনায় নিতে হয়।’
অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটিকে একটি বিষয় যাচাইয়ের জন্য বলেছি, তিনি (সাহেদ) সংশোধনের প্রমাণস্বরূপ যেসব সনদ দিয়েছিলেন তা সঠিক ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে। এটি যদি সংশ্লিষ্ট ইউনিভার্সিটিতে খতিয়ে সত্যতা না পাওয়া যায় তাহলে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করার জন্য তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ জানাব।’
করোনায় সাহেদের কাণ্ড-
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছিল রিজেন্ট। বিনিময়ে তারা জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ৪ হাজার নিতেন। বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করলে এক হাজার টাকা বেশি নেয়া হতো। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২০০টির মতো নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতালটি। পরীক্ষা না করেই বাকি ৬ হাজারের মতো নমুনার রিপোর্টই মনগড়াভাবে তৈরি করে দেয় সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল।
করোনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবেও অনুমোদন পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট। এতে করোনা রোগীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেয়ার কথা ছিল না। তবে র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে, রিজেন্টে রোগীপ্রতি দেড় লাখ, দুই লাখ ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছিল। পাশাপাশি ‘রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে’ এই বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বিল জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এই অর্থ প্রক্রিয়াধীন থাকলেও শেষ পর্যন্ত পায়নি হাসপাতালটি।
এছাড়া হাসপাতালটিতে করোনা টেস্টের অননুমোদিত কিটও পায় র্যাব। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার যে কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি, সেটি দিয়েও টেস্ট করে রিজেন্ট। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কোনো টাকা নেয়ার কথা নয়। টেস্টে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে নিত তারা। যাদের ‘করোনা পজিটিভ’ রিপোর্ট দেয়া হতো, তাদের কাছ থেকে ফের পরীক্ষার জন্য আরও এক হাজার টাকা নেয়া হতো।
এইচএস/এফআর/জেআইএম