মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মিনাপাড়া গ্রামের ইমান আলী। ছোটকালে কথায় কথায় পাশের গ্রামের এক অনাথ মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দেন ইমান আলী। সে সময় গ্রামের মৌলভীর মুখে শুনেছেন ১০১টি বিয়ে দিলে জান্নাতি হওয়া যায়। তখন থেকে শুরু করেন ঘটকালি। গত ২২ বছরে হাজারো ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি।
Advertisement
এখন সবাই তাকে ইমান ঘটক নামেই চেনেন। তবে এখন আর তার হাঁকডাক নেই। প্রথমে মোবাইল পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এসে ঘটকের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। মোবাইল, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ও ইমোর মতো মাধ্যমগুলোতে প্রেম করে এখন ঘটক ছাড়াই বিয়ে করছেন তরুণ-তরুণীরা। কেউ কেউ এসব মাধ্যমে প্রেম করে গোপনেই বিয়ে করছেন। অনেকেই এসব মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে পরিবারের লোকজনকে বলে বিয়ের ব্যবস্থা করছেন। প্রযুক্তির কল্যাণে সুন্দরভাবেই চলছে বিয়ে-শাদি। ফলে এখন আর আগের মতো ঘটকের প্রয়োজন হয় না। বলতে গেলে বিলুপ্তির পথে ঘটকালি প্রথা।
অথচ ১০-১৫ বছর আগেও গ্রামগঞ্জে চোখে পড়তো ঘটকরা পান চিবাতে চিবাতে বগলের নিচে ছাতা নিয়ে হেঁটে চলছেন গ্রামের পর গ্রাম। সজাগ দৃষ্টি কার বাড়িতে রয়েছে বিবাহযোগ্য ছেলে-মেয়ে। অনেক ঘটকের কাছে টাকা-পয়সা মুখ্য নয়, বিয়ের ঘটকালি করে আনন্দ পান। তাদের আবার নিন্দুকের অভাব নেই। বিয়ের পর সংসার সুখের হলে ঘটকের কথা কেউ মনে রাখে না। তবে বিয়ের পর যদি সংসারে অশান্তি কিংবা ছোটখাটো ঝামেলা দেখা দেয় তাহলে সব দোষ ঘটকের।
রাইপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ঘটকদের কথা চালাচালির ধরনই আলাদা। সাতশ সাতবার কথা চালাচালি না হলে নাকি বিয়েই হয় না। অর্থাৎ সামাজিক বিয়েতে কথা খরচ করতে হয় প্রচুর। ঘটকের প্রধান কাজই হলো মেয়ের বাড়িতে ছেলে এবং ছেলের পরিবারের বংশ ও গৌরব, গুণ-গরিমা প্রকাশ করা। ছেলের বাড়িতে মেয়ের রূপ-সৌন্দর্য ও শিক্ষা-দীক্ষা তুলে ধরা। এভাবে দুটি পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলেন ঘটক। ঘটকের মাধ্যমে পছন্দের পর্বটি শেষ হলে বিয়ের কথাবার্তা ও চূড়ান্ত হয় বিয়ের দিনক্ষণ। বিয়ের আগের দিন হয় গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান।
Advertisement
এরপর বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে ভূরিভোজ। ভোজনপর্ব শেষ হলে শুরু হয় বিয়ের মূলপর্ব। কাজি এসে বিয়ে রেজিস্ট্রির কাজটি করেন। বিয়ে হয়ে গেলে চলে কনে বিদায়ের পালা। বরের বাড়িতে বধূবরণসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অন্দরমহলে অর্থাৎ সাজানো বাসরঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় বর-কনের দাম্পত্য জীবন। বিয়ে হলে আসে ঘটক বিদায়ের পালা। ছেলে-মেয়ের পক্ষ থেকে কিছু নগদ টাকা, কখনও জামা-কাপড় ও একটা ছাতা পান ঘটক।
গাংনী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম বলেন, আদিকাল থেকে ঘটকালি প্রথা চলে আসছে। তবে আগে গ্রামগঞ্জে পেশাদার ঘটক ছিল না। টাকা-পয়সা নিয়েও তাদের চিন্তা ছিল না। ১৯৮০ সালের দিকে ঘটক প্রথাটি ব্যাপকতা পায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঘটকের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। এরপর মোবাইল, ফেসবুক ও ইমো এসে ঘটকের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। বর্তমানে ঘটক নিয়ে ঘোরাঘুরি, বিয়েতে অতিরিক্ত খরচ করতে চায় না কেউ। অনেকেই নিজেরাই ঘটকালির কাজটি করছেন। মোবাইল ও ফেসবুকে প্রেম করে কেউ কেউ গোপনে বিয়ে করছেন।
গাংনী উপজেলার রুয়েরকান্দি গ্রামের ঘটক রশিদ বলেন, গত ১৫ বছরে ১৭০৩টি বিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। ঘটকের প্রচলন না থাকায় এখন ঘটকালি ছেড়ে ইজিবাইক চালাই।
তিনি বলেন, আগে ঘটক ছাড়া বিয়ে ভাবাও যেত না। এখন ছেলে-মেয়েরা এমনকি বিধবারাও মোবাইল ও ফেসবুকে প্রেম করে ঘর থেকে পালিয়ে বিয়ে করছে। এখন ছেলে-মেয়ে নিজেরাই নিজেদের দেখে। পছন্দ হলে পরিবারের লোকজনকে বিয়ের আয়োজন করতে বলেন। নিজেরাই করছেন সবকিছু। এখন আর ঘটকের প্রয়োজন পড়ছে না। আগে ঘটকের আগমনে বিয়েবাড়িতে নানা গীত গাইতো, যা বিভিন্ন নাটক-সিনেমায়ও দেখা যায়। এখন তো পারিবারিকভাবে বিয়ে নেই বললেই চলে। বর্তমানে যা আছে সামনে তাও থাকবে না। ঘটকালি প্রথা শেষ। প্রযুক্তিই দিন দিন মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে। মানুষও তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
Advertisement
আসিফ ইকবাল/এএম/এমকেএইচ