ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ও ব্যাংকের তারল্য সংকটসহ নানা কারণে গত অর্থবছরজুড়ে বেসরকারি খাতে ঋণের চাপ কম ছিল। মহামারি করোনার কারণে ঋণের গতি আরও কমেছে। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমেছে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে। এ হার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সর্বনিম্ন। তবে বেসরকারি ঋণ কমলেও উল্টো চিত্র সরকারি ঋণে। গেল অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিয়েছে সরকার।
Advertisement
গেল অর্থবছরের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্ত তা অর্জন হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয় ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া মানে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। এই অবস্থা প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও সেবা খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। করোনার কারণে সামনে আরও খারাপ হবে।
এখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়াতে হবে জানিয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেসরকারি ঋণ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। যে কোনো প্রক্রিয়ায় ঋণ বাড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে রফতানি, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প ও উৎপাদনমুখী খাতকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। অনিয়ম অব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকিং খাতের নানা সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করতে হবে।
Advertisement
পাশাপাশি সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানো ও বিদেশি উৎস থেকে কম সুদে ঋণ আনার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুন শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৮৭ হাজার কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ১০ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছর থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কম। করোনার কারণে আরও কমে গেছে। তবে এখন সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের ঋণ বিতরণ চলছে, এখন প্রবাহ বাড়বে। তবে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে এটাও একটা বড় সমস্যা। সরকার যদি ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় তাহলে বেসরকারি খাতে এর প্রভাব পড়বে, এটা তো স্বাভাবিক। কারণ ব্যাংকের নির্দিষ্ট অর্থ থেকেই ঋণ যাবে। এক খাত বেশি পেলে অন্য খাতের অর্থ কমে যাবে।
মহামারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে পড়ায় সরকারের রাজস্ব আহরণ কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে খরচের পরিমাণ। ফলে ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে ব্যাংক খাত থেকে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিচ্ছে সরকার। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর আগে কোনো সময় সরকার ব্যাংক থেকে এতো ঋণ নেয়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঋণ নেয় ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা।
Advertisement
এছাড়া নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকাসহ মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা নিতে চায় সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি খাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি কমে হয় ১৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর পরের ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ব্যাপকহারে কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৫ শতাংশে। এরপর টানা তিন অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বাড়ে। ২০১৩-১৪ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয় ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয় ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেটি আবার বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনক হারে কমে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশে দাঁড়ায়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা রেকর্ড পরিমাণ কম হয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে।
এসআই/এএইচ/পিআর