বৈশ্বিক করোনাভাইরাস (কোভিড- ১৯) মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশকেও বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। চ্যালেঞ্জের মধ্যেও বিশাল অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে। মূলত, মার্কিন-চীন সম্পর্কের উত্তেজনার প্রভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনায়নে ব্যাপক তৎপরতা চলছে। এমন তৎপরতাই বাংলাদেশের সামনে অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
Advertisement
তারা বলছেন, সম্ভাবনার এমন সুযোগ কাজে লাগাতে লক্ষ্যভিত্তিক, সময়োপযোগী এবং কেন্দ্রীভূত বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণে প্রতিবন্ধকতা দূর করার যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
করোনা-পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ কেন প্রয়োজন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়— তা নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার বিষয়ক কর্মকর্তা অ্যালিস ওয়েলস সম্প্রতি বলেছেন, কোভিড-১৯ এর পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি লাভবান হতে পারে। তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের বৈচিত্র্যের সময় এখন। বাংলাদেশের জন্য এই সময়টা একটা সুযোগও হতে পারে।’ অ্যালিস ওয়েলসের এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তা বাংলাদেশকে শুধু কোভিড- ১৯ এর পতন থেকে রক্ষাই করবে না, বরং এই দেশে দীর্ঘমেয়াদে বড় অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ চালু রাখতেও সহায়তা করবে।
Advertisement
মার্কিন-চীন সম্পর্কের চরম উত্তেজনার পাশাপাশি করোনার উৎপত্তিস্থল চীন হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বর্তমান মন্দাবস্থার জন্য দেশটিকে দায়ী করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশ এবং তাদের মিত্ররা। দেশগুলো উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় চীনের একক আধিপত্যের লাগাম টানতে পূর্ব-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে নতুন নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
চায়নার উৎপাদন শিল্পে যাদের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে অর্থাৎ জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে স্থানান্তরের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। তাদের অনেকেই স্থানান্তরে জন্য বিশেষ প্রণোদনাও ঘোষণা করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই স্থানান্তরিত সম্ভাব্য এই বিনিয়োগের সুবিধা গ্রহণ করতে হবে।
‘বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নানা সুবিধা বিদ্যমান’ উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন পর্যাপ্ত রয়েছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার ওঠা-নামার হারও কম। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে (মাত্র ৫-৬ শতাংশ) রয়েছে। শ্রমিক সস্তা, বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও বেশ ভালো। এখন শুধু সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
এদিকে যে দেশটিকে নিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যে টালমাটাল অবস্থা সেই চীনই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নয়নে বেশ সচেষ্ট। দেশটি তাদের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি আরও পাঁচ হাজার ১৬১টি নতুন পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দিয়েছে। যা কার্যকর হয়েছে গত ১ জুলাই থেকে। অর্থাৎ করোনা মহামারির মধ্যেও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক আরও দৃঢ হলো বাংলাদেশের। এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট বা আপটার আওতায় আগে থেকেই দেশটিতে তিন হাজার ৯৫টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা ভোগ করে আসছে বাংলাদেশ। এখন সবমিলিয়ে আট হাজার ২৫৬টি পণ্য এ তালিকায় এলো।
Advertisement
একইভাবে ২০১১ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে অধিকাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা দিয়ে আসছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পৃথিবীর বৃহৎ দুই বড় অর্থনীতির মার্কেট যেহেতু আমাদের কাছাকাছি অবস্থিত এবং দেশ দুটিতে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশের ব্যাপক সুবিধা রয়েছে সেহেতু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চাইবে বাংলাদেশে তাদের পণ্য উৎপাদন করে বিশাল মার্কেট দুটি ধরতে। শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা নিয়ে তারা পণ্যের ভালো মূল্যও পাবে। এ কারণে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্টের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দ্রুত প্রস্তুতের তাগাদা দেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বলছে, সব মিলিয়ে সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির লক্ষ্য ঠিক করেছে। এখন জোরেশোরে কাজ চলছে ২৮টির। এর মধ্যে ১৩টি সরকারি খাতে। বেসরকারি খাতে ১৫টি। বেজার হাতে ইতোমধ্যে ৫০ হাজার একরের মতো জমি এসেছে, আর বিনিয়োগের জন্য প্রায় দুই হাজার একর জমি বর্তমানে প্রস্তুত রয়েছে।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি ইতোমধ্যে সরকারের কাছে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছে। এগুলোর সুষ্ঠু ও দ্রুত বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করছে আগামীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, মার্কিন-চীন সম্পর্কের অবনতির পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমানে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগের ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চিহ্নিত প্রতিবদ্ধকতাগুলো দ্রুত দূর করতে হবে। কারণ এ সুযোগ বারবার আসবে না। তাই যা করার সরকারকে দ্রুতই করতে হবে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, এতদিন আমরা চায়নার মার্কেটে মাত্র ৬১ থেকে ৬২ শতাংশ পণ্যে ডিউটি ফ্রি (শুল্কমুক্ত) সুবিধা পেতাম। কিন্তু এখন তারা ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়া ভারতও আমাদের ডিউটি ফ্রি সুবিধা দেয়। কাছাকাছি বড় অর্থনীতির দুটি দেশ এ সুবিধা দেয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের ক্ষেত্রে এ বিষয়টাও বড় ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠান চীনে বিনিয়োগ করে, সেখান থেকে পণ্য উৎপাদন করে আবার যুক্তরাষ্ট্রেই বাজারজাত করে। ৯৭ শতাংশ পণ্যে ডিউটি ফ্রি সুবিধার ফলে অন্যান্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চীনের কোম্পানিও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে তাদের দেশে পণ্য রফতানি করতে পারে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে চায়নাদের অন্যান্য দেশে প্রবেশাধিকার একটু কঠিনই হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ সুযোগটা নিতে পারে।
ড. রাজ্জাক বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চায়না বাংলাদেশে ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা খুব বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেনি। বর্তমানে চায়নায় ডিউটি ফ্রি’র সুবিধার কারণে সেদেশের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছিল ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে চায়নার একারই বিনিয়োগ ছিল ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ আগে থেকেই চীন বাংলাদেশের বিনিয়োগ অংশীদার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তিনি আরও বলেন, চায়না পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বড় অর্থনীতির মার্কেট। তাই পৃথিবীর সব দেশের উদ্যোক্তারা এ মার্কেট ধরতে বেশ আগ্রহী। যেহেতু চায়নায় ৯৭ শতাংশ পণ্যে ডিউটি ফ্রি সুবিধা আমরা পাচ্ছি সেহেতু চায়নার মার্কেটে পণ্য রফতানির জন্য ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাবে।
এ বিষয়ে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও সাবেক বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রাইভেট সেক্টর স্পেশালিস্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম মাসরুর রিয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইতোমধ্যে তা বাস্তবায়ন করে ফেলেছে। তাই তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাস্তবায়নের দ্রুততা বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্বলতা। এটা দ্রুত ঠিক করতে হবে।
তিনি বলেন, ডুয়িং বিজনেসের সূচকেও আমরা অনেক পিছিয়ে। এটার সংস্কারের জন্য অনেক প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ইমপ্রুভমেন্টের সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে অনেক কিছু সংস্কার করেছে। একইসঙ্গে আগামীতেও বেশকিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে। ফলে করোনাকালে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটা আমরা কাজে লাগাতে পারব।
ইতোমধ্যে সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল কিছু কিছু পণ্যের জন্য ডেডিকেটেড করা হচ্ছে। আমাদের রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক শ্রম বাজার। এছাড়া কর্পোরেট ট্যাক্স, ভ্যাট কমানোসহ কর অব্যাহতি; দ্রুত ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু; ভূমি অধিগ্রহণ সুবিধা ও ব্যাংকিং জটিলতা নিরসনসহ একগুচ্ছ প্রস্তাবনা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে দেয়া আছে। সেগুলোর বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিদেশিরা খুবই আত্মবিশ্বাসী হবেন।
‘করোনার কারণে রফতানি প্রক্রিয়ায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও গত দুই মাসে আমাদের আশাব্যঞ্জক রফতানি হয়েছে। আমরা কিন্তু কামব্যাক করতে শুরু করেছি। এটাও বিদেশি বিনিয়োগ আসার বড় একটা কারণ হতে পারে’— বলেন ব্যবসায়ী এই নেতা।
এমইউএইচ/এমএআর/পিআর