‘চোখের সামনে আমার ৬ বিঘা জমির আউশ ধান ডুবে গেল, আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। আর এক সপ্তাহ পরেই ধানগুলোর শীষ বের হত। বোরো ধান কাটার পরপরই তড়িঘড়ি করে জমি চাষ দিয়ে এই আউশ ধান করা হয়েছে। ৬ বিঘা জমিতে কমপক্ষে ১২০ মন ধান পেতাম। যার দাম এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকা বানের পানিতে গেল।’ এভাবেই কথাগুলো ফোনে বলছিলেন বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার উল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক হেলাল খাঁ। একইরকম কথা বললেন, একই গ্রামের কৃষক জয়নাল তালুকদার। তারও তিন বিঘা জমির ধান ডুবে গেল বানের পানিতে।
Advertisement
এ কথা শুধু হেলাল খাঁ আর জয়নাল তালুকদারের না। বৃষ্টি-বন্যায় হাজারও কৃষকের কণ্ঠে শুধু এখন আফসোসের সুর। হেলাল বলেন, ‘ধুনট উপজেলার উল্লাপাড়া, চরপাড়া, ফকিরপাড়া, শৈলমারী, নলডাঙ্গা, এলাঙ্গী, গোসাইবাড়ী, ভাণ্ডারবাড়ী, শিমূলবাড়ী, শেরপুর উপজেলার, শালপা, গজারিয়া, রোরৈতলী, বোয়ালকান্দিনহ ধুনট ও শেরপুর উপজেলার ২০ ইউনিয়নের কয়েক হাজার বিঘা জমির ফসল গত ৩-৪ দিনে পানির নিচে চলে গেছে। এতে কৃষকরা খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ আউশ ধান ঘরে আসবে আর মাত্র এক মাস পরে। এই আশায় অনেকে ঘরে রাখা ধানও বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন তারা মহাবিপদের মধ্যে আছেন।’
উজানের ঢল এবং অতিবৃষ্টিতে গত জুন মাস থেকে সৃষ্ট বন্যায় উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়। তবে এবার শুধু নিন্মাঞ্চল নয়, উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলাসহ জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ ১৭টি জেলায় বন্যা হচ্ছে। এর ফলে এসব অঞ্চলে আউশ ধানসহ, পাট, সবজি, বাদাম, তিল ইত্যাদি ফসল ডুবে গেছে।
এর আগে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘বন্যায় কিছু আউশের জমি ডুবে গেলেও লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে না। কারণ অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২ লাখেরও বেশি হেক্টর জমিতে আউশের চাষ হয়েছে।’
Advertisement
এর প্রেক্ষিতে কৃষকরা বলছেন, ‘মন্ত্রীরাতো তাদের মতো করে হিসাব দেয়। তারা সব সময় নিজেরা বাঁচতে চায়। হিসাব করলে ১৭টি জেলার যে যে উপজেলায় আউশ ধান বানের পানিতে ডুবে গেছে তার পরিমাণ ২ লাখ হেক্টরের উপরে হবে। ফলে আউশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। কিছু দিন আগে বলেছেন, নিন্মাঞ্চলের সামান্য কিছু জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
গত ২০ জুলাই কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বন্যায় প্রাথমিকভাবে প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বন্যায় আউশ, আমন, সবজি, পাটসহ বেশ কিছু ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিকল্প বীজতলা তৈরি, ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে বিকল্প ফসলের চাষের ব্যবস্থা, নিয়মিতভাবে আবহাওয়া মনিটরিংসহ প্রস্তুতি চলছে যাতে করে বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি মোকাবিলা করা যায়।’
কৃষি মন্ত্রণালয় এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যখন অতিরিক্ত আউশ উৎপাদনের আশা করছে তখন সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যায় অনেক কৃষকের ধান ডুবে আছে পানি নিচে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা এক ছটাক ধানও ঘরে তুলতে পারবেন না। কারণ বন্যার পানিতে ডুবে তাদের ধান পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
জানা গেছে, কুড়িগ্রামে বন্যায় কৃষি ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে ৫ হাজার ৬৫৩ হেক্টর। এর মধ্যে আমন বীজতলা ৪৩৫ হেক্টর, আউশ ৮২৫ হেক্টর।
Advertisement
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যায় এক হাজার ৬৯২ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।’
গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যার পানিতে জেলায় ১৯৬ হেক্টর আউশ ধান পানিতে ডুবে গেছে।’
সিরাজগঞ্জ জেলার জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জে ৫৫ হেক্টর আউশ ধান নষ্ট হয়েছে। এছাড়া এক হাজার ৫০৯ হেক্টর জমির অন্যান্য ফসলও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
জামালপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, জেলায় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ২৮৬ হেক্টর জমির আউশ ধান। এছাড়া ৬৫ হেক্টর আমনের বীজতলাও ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. শাহজাহান কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন এক ইঞ্চি জমি ফেলে রাখা যাবে না। প্রতি ইঞ্চি জমিকে কাজে লাগাতে হবে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ চাষ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। যা গত বছরের চেয়ে ২ লাখ হেক্টরের বেশি। বরিশালে যে সব জমি পতিত থাকত, কোনো আবাদ হতো না এবার সেসব জমি আউশ আবাদের আওতায় এসেছে। কিন্তু প্রকৃতির ওপর তো আমাদের হাত নেই। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরাসহ নানা দুর্যোগ মাথায় নিয়েই আমাদের বসবাস। চাষিরা সরকারের সহযোগিতা পেয়ে যে আউশ চাষ করেছিল তার অনেক ফসলই বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার অবশ্য পরবর্তী ফসলে সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী অবশ্য সকল সুযোগ সুবিধার কথা বলেও দিয়েছেন। তাতে হয় তো কৃষক পুষিয়ে নিতে পারবেন।’
এফএইচএস/এফআর/এমএস