প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে গাজীপুর থেকে গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে ফিরছিলেন তাহেরা বেগম (৩৫)। পেশায় পোশাককর্মী তাহেরা বাড়ি পৌঁছার আগেই খবর পান, তার শরীরে বাসা বেঁধেছে করোনা। এই খবরে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন এই সংক্রমণ? কীভাবেই বা চলবে সংসার? এমন হাজারও প্রশ্ন জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্টে।
Advertisement
তাহেরা গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের কালিনগর জামাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার স্বামীর নাম মাহবুব আলী। তবে আরেক স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকেন স্বামী।
মা রোজিনা বেগম (৫০), ছেলে তারেক রহমান (১৪) ও মেয়ে সুমনা খাতুনকে (১২) নিয়ে আলাদা থাকেন তাহেরা। সংসারের চাকা সচল রাখতে তাহেরা ঢাকায় পাড়ি দেন। ২০০৮ সালের শুরু থেকে কাজ করছিলেন গাজীপুরের একটি পোশাক তৈরির কারখানায় ফিনিশিং আয়রনম্যান হিসেবে। করোনায় হারাতে বসেছেন সেই চাকরি।
করোনা নিয়ে গ্রামে ফিরে বাড়ির পাশের আমবাগানে একাই আশ্রয় নেন। পরদিন থেকে আম বাগানে অস্থায়ী টিনের ছাপড়া ঘরে ঠাঁয় হয় তার। এরপর সেখানেই একে একে কেটে গেছে ৫০ দিন। করোনার সাথে একলা লড়াইয়ে টিকে রয়েছেন অদম্য এই নারী।
Advertisement
তাহেরা বেগমের ভাষ্য, প্রথম দিকে তার গলা ভারী হয়ে আসছিল। তারপর শুরু হলো গলা ব্যাথা। কিন্তু শ্বাসকষ্ট ছিল না। ধীরে ধীরে তিনি শারীরিকভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েন। অফিস কর্তাদের পরামর্শে ৩০ মে কর্মস্থলেই করোনা পরীক্ষায় নমুনা দেন।
তিনি ধরেই নিয়েছিলেন তার টনসিল সমস্যা। সমস্যা বাড়তে থাকায় অপারেশনেরও সিদ্ধান্ত নেন। আর খরচ যোগাতে বাড়িতে থাকা গরুটিও বিক্রি করে দেন। এরপর লকডাউন কিছুটা শিথিল হলে সুযোগ বুঝে ৫ জুন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পথেই অফিস থেকে জানানো হয়-তার করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। পরিবারের সুরক্ষায় বাড়ি ফিরে আলাদা থাকারও পরামর্শ দেয়া হয় তাকে।
তিনি জানান, অসুস্থ শরীরে যখন বাড়ি ফেরেন তখন গভীর রাত। পরিবারের কথা ভেবে ওই রাতে বাড়ির পাশের আম আগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার মাথার ওপর দিয়ে ওই রাতে বয়ে যায় প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। সামান্য পলিথিনে কোনোরকমে নিজেকে আবৃত করে রাখেন তিনি।
সকালে ওই আম বাগানেই শ্রমিক লাগিয়ে টিনের বেড়া ও ছাউনি দিয়ে ছাপড়া ঘর বানিয়ে দেন মা। তাকে কোনোরকমে একটা চৌকি পাতা গেছে।
Advertisement
ওই ঘরেই একমাস একেবারেই অবরুদ্ধ কাটাতে হয়। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আর থাকতে পারেননি। কিন্তু এখনও রাত কাটাতে হচ্ছে সেখানেই।
তাহেরা বলেন, তার করোনা শনাক্তের খবর পেয়ে ওইদিন সকালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সচিব এসেছিলেন। তাদের সাথে চৌকিদারও ছিল। উপজেলা প্রশাসনের বরাত দিয়ে তারা জানিয়ে যান, তিনি যেন এই ঘর থেকে বের না হন।
ওইদিনই তাকে ৫ কেজি চাল, দুই কেজি আলু এবং এক লিটার তেল দেয়া হয়। তা শেষে হয়ে যায় দুই দিনেই। এরপর আর কোনো সহায়তা পাননি। পরিস্থিতি দেখে তার সহায়তায় এগিয়ে আসেন গ্রামবাসী। চাল-ডাল সংগ্রহ করেই তারাই পৌঁছে দিয়ে যান।
শুরুতে চৌকিদারকে দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ৫ দিনের ওষুধ পৌঁছে দেন। সেই ওষুধ শেষ হবার পর আর ওষুধও পাননি। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলেও পাননি চিকিৎসা সেবা।
১৪ দিন পর দ্বিতীয় দফা নমুনা পরীক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তাহেরা বেগম। তিনি বলেন, তাকে জানানো হয়েছিল ১৪ দিন পর তার নমুনা নেয়া হবে। চৌকিদার, মেম্বার, চেয়ারম্যান, এমনকি ডিসিকেও ফোন দেন।
আজ-কাল করতে করতে হয়ে গেল দুই মাস। এখনও পরীক্ষা করাতে পারেননি। ফলে চাকরিতেও ফিরতে পারেননি। যে চাকরি তার একমাত্র সম্বল সেই চাকরি এখন যায়যায়।
তাহেরা আরও জানান, শুরু থেকেই ইউনিয়ন পরিষদ সচিব তার খোঁজখবর রাখছিলেন। তাকেও বারবার নমুনা পরীক্ষার অনুরোধ করেন, তিনি গুরুত্ব দেননি। তার প্রশ্ন-এই পরিস্থিতিতে চাকরি হারালে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবেন কীভাবে?
নিরূপায় হয়ে তিন দিন আগে তিনি রহনপুরে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সেদিনও তার নমুনা পরীক্ষা হয়নি। একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল। পরে তারা যোগাযোগ করে তথ্য নেন। শনিবার (২৬ জুলাই) তাকে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, বর্ষায় আমবাগানের একটি অংশ জলমগ্ন। তাহেরা বেগমের ছাপড়া ঘরটি দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে। সন্ধার কিছুটা আগে কাদাপানি মাড়িয়ে বাড়ি ফেরেন তাহেরা। বাড়ির দরজার নামনেই পাওয়া গেল তাকে।
তিনি জানালেন, সন্তানদের জন্য খাবার রান্না করতেই তিন বেলা বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের কড়াকড়িতে এখনও রাত কাটাচ্ছেন ওই অস্থায়ী ঘরেই।
রাস্তাঘেঁষা খাস জমিতে টিনের ঘর তুলে বাস করে আসছেন তাহেরা বেগম। এটুকই তার সম্বল। করোনায় চাকরি হারানোর উপক্রম হলেও এখনও বেঁচে আছেন এটাই সান্ত্বনা।
তাহেরা বেগমের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা অমানবিক বলছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, কী ইউনিয়ন পরিষদ, কী উপজেলা প্রশাসন, তারা করোনা পেলে কেবল বাড়ি লকডাউন করে যায়। মাইকিং করে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে আক্রান্ত পরিবার মরল নাকি বাঁচল সেখবর নেয়ার লোক নেই।
এই বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শুকুরুদ্দিনকে পাওয়া যায়নি। ফোন রিসিভ করে ছেলে আবদুস সালাম জানান, তার বাবা কয়েকদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন ইউনিয়ন পরিষদ সচিব রবিউল ইসলাম। তার দাবি, শুরু থেকেই তিনি তাহেরা বেগমের খোঁজখবর রাখছিলেন। নমুনা নেয়ার জন্য তিনিও বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু নমুনা দিতে পারেননি।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। এমনটি হয়ে থাকলে ইউনিয়ন পরিষদ সেটি বলতে পারবে।
এ বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, উপসর্গ না থাকলে ১৪ বা ২১ দিন পর সংক্রমিতদের সুস্থ বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু ওই নারীর এতদিন এভাবে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কেন এমন হলো বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।
এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল, তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ জেড এম নূরুল হক। ওই নারীর দ্রুত নমুনা পরীক্ষাসহ এই নিয়ে কারও অবহেলা পেলে ব্যবস্থা নেয়ারও আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।
জেডএ