কোভিড- ১৯ (করোনাভাইরাস) মহামারির কারণে দেশে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি থাকে। এরপর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে চলছে সরকারি অফিস। মহামারি পরিস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে অর্থনৈতিক গতি। টান পড়েছে জীবিকায়, আয়ের পথ হারিয়েছে বহু মানুষ। করোনার কারণে প্রশাসনের নানা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে প্রশাসন। মহামারি করোনার কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সবধরনের প্রশিক্ষণ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও সংস্থাগুলোকে কাজের লক্ষ্যমাত্রা বেধে দিয়ে যে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি হয়, সেটিও ব্যাহত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো জেলা প্রশাসক সম্মেলনও করা যাচ্ছে না এবার। বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও।
Advertisement
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কিছুদিন আগে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড- ১৯ এর কারণে জনপ্রশাসনের যুগ্ম সচিব-উপসচিব ও সমপর্যায়ের ২০০ কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক সেন্ট্রাল ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিসিআইডি), স্যানফোর্ড স্কুল অব পাবলিক পলিসি, ডিউক ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণের জন্য যুগ্ম সচিব ও সমপর্যায়ের ১০০ কর্মকর্তা মনোনীত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম ব্যাচের ৫০ কর্মকর্তার ১ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ব্যাচের ৫০ কর্মকর্তার ১৫ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত প্রোগ্রাম বর্তমানে নোভেল কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হলো।
Advertisement
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একই প্রকল্পের অধীনে উপসচিব ও সমপর্যায়ের ১০০ কর্মকর্তার অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককোয়াইর ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম ব্যাচের ৫০ কর্মকর্তার ২৯ জুন থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় ব্যাচের ৫০ কর্মকর্তার ১ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা ছিল। এই প্রোগ্রামও বর্তমানে নোভেল কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
করোনায় আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) প্রণয়নের সময়সীমা, একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) এপিএ মূল্যায়নও পিছিয়েছে।
চলমান অর্থবছরের এপিএ প্রণয়নের সময়সীমা বর্ধিত এবং সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরের মূল্যায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ইতোমধ্যে সকল মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সাধারণত অর্থবছরের শুরুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থাগুলোকে লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হয়, এ বিষয়ে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি হয়। জুনের মধ্যে অধীনস্থ সংস্থাগুলোর সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এপিএ করে থাকে। জুলাইয়ের শুরুতেই মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোর সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চুক্তি হয়ে থাকে। অর্থবছর শেষে হয় মূল্যায়ন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কতটুকু অর্জিত হলো। কিন্তু করোনার কারণে চুক্তি ও মূল্যায়ন সময়মতো করা সম্ভব হচ্ছে না।
Advertisement
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কোভিডের কারণে আমরা এবার সময়মতো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি করতে পারিনি, তাই বলে কাজ থেমে নেই। মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং মাঠপ্রশাসন এটা নিয়ে কাজ করছে। পরিস্থিতি অনুকূলে আসলে তখন চুক্তি হবে।
প্রতি বছর জুলাই মাসে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন হলেও এবার তা হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে জেলা প্রশাসক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে।
সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনা-সামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রতি বছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গত বছর ১৪ থেকে ১৮ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন অনুবিভাগ) আ. গাফফার খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার আপাতত ডিসি সম্মেলন হচ্ছে না। পরিস্থিতির কারণে পরে হবে। আগে পরিস্থিতির উন্নতি হোক, তারপর উদ্যোগ নেয়া হবে।’
জেলা প্রশাসক সম্মেলন উপলক্ষে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা লিখিতভাবে মাঠপ্রশাসনের সমস্যাগুলো নিয়ে প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। অধিবেশনের সময় এগুলো ছাড়াও ডিসিরা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। কার্যঅধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থেকে এসব সমস্যা সমাধানে দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০১৯-২০) সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও ধীরগতি নামিয়ে দিয়েছে করোনা মহামারি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। এ হিসাবে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দকৃত দুই লাখ এক হাজার ১৯৯ কোটি টাকার মাত্র ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
বাস্তবায়ন বিবেচনায় এটি বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত ২২ মার্চ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাতীয় অর্থনেতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আইএমইডির একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি বলেন, করোনার কারণে এবার চার মাস ঠিকমতো কাজ হয়নি। ফলে এডিপি বাস্তবায়নের হার অন্যান্য বছরের চেয়ে কম।
মার্চ মাসের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী ধরা পড়ে। পরিস্থিতি ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, গত ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ছিল। পরে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে দেয়া হয়, চালু করা হয় গণপরিবহন। পরে এই ব্যবস্থা দুই দফায় অর্থাৎ আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
আরএমএম/এমএআর/পিআর