পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) স্বাক্ষর জাল করে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের ১ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তপন কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে। আশ্রয়ন প্রকল্পের ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ছয়টি ঘাটলা নির্মাণের বরাদ্দ ছিল এক কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা। কিন্তু কোনো কাজ না করে পিআইও এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সারিকা ট্রেডার্সের কয়েকজন সত্ত্বাধিকারীর যোগসাজশে বিলের ওই টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে। বিষয়টি জানাজানি হলে নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন থেকে বিভাগীয় প্রশাসন। ঘটনাটি তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
Advertisement
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার অমিতাভ সরকার জানান, কলাপাড়ার বিষয়টি সম্প্রতি তিনি শুনেছেন। পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসনকে তিনি ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ন-২ প্রকল্প তেজগাঁও ঢাকা এর স্মারক নম্বর-০৩.০২.০০০০.৭০১.০২.০৯৬.১৯.১৩১৪ তারিখ ঃ ৩১ ডিসেম্বর-২০১৯ চিঠিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। যেখানে কলাপাড়ায় খাজুরা, চালিতাবুনিয়া, গোড়া আমখোলা, ছোট বালিয়াতলী, ফতেপুর, লক্ষ্মী বাজার, নিশানবাড়িয়া, গামুরিবুনিয়া, নীলগঞ্জ ও নিজশিববাড়িয়া আশ্রয়ন প্রকল্পের জন্য প্রত্যেকটি কমিউনিটি সেন্টারের নির্মাণ ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয় ৯ লাখ ৮০ হাজার ১১৩ টাকা। এছাড়া নিশানবাড়িয়া ও গামুরি বুনিয়া আশ্রয়ন প্রকল্পের দুটি ঘাটলা নির্মাণ ধরা হয় ব্যয় ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা।
নীলগঞ্জ ও গোড়াআমখোলা পাড়া আশ্রয়নের দুটি ঘাটলা নির্মাণ ব্যয় চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা এবং খাজুরা ও ফাসিপাড়া দুটি ঘাটলা নির্মাণ ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয় চার লাখ ৫৮ হাজার ৮৩৫ টাকা। বাস্তবে এ ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ছয়টি ঘাটলার কোনো কাজ করা হয়নি। কিন্তু সেখানে সকল বিল বাবদ মোট ১ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সারিকা ট্রেডার্স তুলে নিয়েছে।
Advertisement
কলাপাড়ার চম্পাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিন্টু তালুকদার এবং লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা জানান, বাস্তবে ১০টি কমিউনিটি সেন্টার ও ছয়টি ঘাটলার আদৌ কোনো কাজ করা হয়নি। অথচ এসব কাজের বিপরীতে বিল বাবদ এক কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সারিকা ট্রেডার্স গলাচিপার সোনালী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে কলাপাড়া হিসাবরক্ষণ অফিসের ব্যয় বরাদ্দ বিলের ভাউচারের মাধ্যমে হস্তান্তর করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব বিলে ২২ মার্চ বদলি হওয়া কলাপাড়ার ইউএনও মো. মুনিবুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। বিলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তপন কুমার ঘোষের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে তপন কুমার ঘোষের স্বাক্ষরটি জাল করার চেষ্টা করা হয়নি। তপন কুমার ঘোষ সরকারি নথিপত্রে যেভাবে স্বাক্ষর করেন বিলেও সেভাবে তার স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়া বিলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্মারক নম্বর ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, এর আগে তপন কুমার ঘোষ কুষ্টিয়া সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) পদে থাকাকলীন বিভিন্ন প্রকল্প সভাপতিদের স্বাক্ষর জাল করে ১০০ মেট্রিক টন সরকারি চাল আত্মসাত করেন। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে তপন কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক বারেকুজ্জামান তাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।
একইভাবে ২০১৯ সালে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) পদে থাকাকলীন তপন কুমার ঘোষ গ্রামীণ অবকাঠামো (টিআর) প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ফর্মে স্থানীয় সংসদ সদস্য (পটুয়াখালী-৪) মহিবুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করেন। এছাড়া ওই সময় গ্রামীণ রাস্তা টেকসই করার প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ ফর্মে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাশফাকুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করেন তপন কুমার ঘোষ। বিষয়টি পরে ধরা পড়লে তপন কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে রাঙ্গাবালী থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়।
Advertisement
রাঙ্গাবালী থানা পুলিশের ওসি আলী আহম্মেদ জানান, তপন কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে দেয়া লিখিত অভিযোগটি বর্তমানে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে স্বাক্ষর জালের ঘটনা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ওই ঘটনায় তপন কুমার ঘোষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে মামলার প্রক্রিয়া চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মুনিবুর রহমান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পদ থেকে গত ২২ মার্চ বদলি হন। এর আগে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের এক কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা বিলে স্বাক্ষরের জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওই বিল নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কার্যালয়ে যান প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসের অফিস সহায়ক মো. মনির হোসেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুনিবুর রহমান তখন বিলের নথি পত্রে স্বাক্ষর না করে ফেরৎ পাঠন।
এরপর তপন ঘোষ ও মেসার্স সারিকা ট্রেডার্সের কয়েকজন সত্ত্বাধিকারীর যোগসাজশে ওই বিলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের স্বাক্ষর জাল করা হয়। পরবর্তীতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির গলাচিপা সোনালী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে (চলতি- ৪৩১০২০০০০১৫০৫) কলাপাড়া হিসাব রক্ষণ অফিসের ব্যয় বরাদ্দ বিলের ভাউচারের মাধ্যমে এ টাকা তুলে নেয়া হয়।
তবে এ সকল বিল ভাউচারের সাত নম্বর কলামে চেক ইস্যু করার জন্য আশ্রয়ন-২ প্রকল্প, কলাপাড়া উপজেলা, চলতি হিসাব নম্বর-৫০৭০৯০১০০১১৩৬, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড কলাপাড়া শাখার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু ওই লাইনটি কেটে মেসার্স সারিকা ট্রেডার্স গলাচিপা শাখার সোনালী ব্যাংকের উপরোক্ত হিসাব নম্বরে বিল করে সরাসরি কলাপাড়া থেকে ওই টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কলাপাড়ার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুনিবুর রহমান বলেন, আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের এক কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকা বিলের কোনো কাগজে তিনি স্বাক্ষর করেননি। বিলে যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার স্বাক্ষরের সঙ্গে মিলবেও না। কলাপাড়া থেকে বদলি হয়ে চলে আসার পর ওই বিলে তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। কলাপাড়ায় চাকরিকালীন দাফতরিক বিভিন্ন কাজে আমাকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। অফিসের নথিপত্রে রক্ষিত ওই সব স্বাক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে স্বাক্ষর আমার না।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কলাপাড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) তপন কুমার ঘোষ বলেন, কিভাবে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের ১ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৩৫ টাকার বিলটি পাস হয়েছে তার জানা নেই। এমনকি ওই বিলে তার স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ইউএনওর স্বাক্ষর জালের যে অভিযোগ উঠেছে তা ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সারিকা ট্রেডার্সের অন্যতম ব্যবসায়িক অংশিদার মো. শামীম জানান, আমাকে কলাপাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস থেকে ফোন করে প্রকল্পের বিল তৈরির বিষয়টি জানানো হয়। এর প্রেক্ষিতে আমি গিয়ে টাকা তুলে নিয়েছি। তবে করোনার কারণে শ্রমিক সংকট থাকায় তখন প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব হয়নি।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী জানান, প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি। কাজ না করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে টাকা তুলে নিয়ে গেল এবং এর সঙ্গে কারা সম্পৃক্ত তা তদন্ত করে দেখা হবে।
সাইফ আমীন/এফএ/এমকেএইচ