কৃষিবিদ জিয়াউল হক
Advertisement
ফসলের অনিষ্টকারী শত্রু পোকা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বন্ধু পোকাও। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত উপায়ে ক্ষেতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের কারণে এসব বন্ধু পোকার বিনাশ ঘটতে চলেছে। ফসলের বন্ধু হিসেবে চিহ্নিত সেসব পোকা রক্ষার লক্ষ্য নিয়েই বাংলদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহযোগিতায় সারাদেশের কৃষকদের আলোক ফাঁদ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
আমন ধান ও সবজি খেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে ব্যবহার হচ্ছে ‘আলোক ফাঁদ’। পরিবেশবান্ধব ও খরচ কম হওয়ায় কৃষকরা এ প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আমন ধানে রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ করে ধানের থোড় বের হওয়ার সময় বেশি পোকামাকড় আক্রমণ হয়। এ সময়ে ধানে বাদামি ঘাস ফড়িং, সবুজ ঘাস ফড়িং, পাতামোড়ানো পোকা, গান্ধী পোকা ও মাজরা পোকাসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করে। পোকার উপস্থিতি নির্ণয় করতে আমন খেতে আলোক ফাঁদ ব্যবহার খুবই উপযোগী। কৃষকরা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও সহায়তায় জমিতে এ আলোক ফাঁদ স্থাপন করে থাকেন।
কৃষিবিদদের মতে, ফসলি জমিতে অনিয়মিত ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শত্রু পোকার পাশাপাশি মিত্র পোকাও ধ্বংস হচ্ছে। এতে ফসলি জমির পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। যা অদূর ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রের জন্য একটি বড় রকম বিপর্যয় হয়ে দেখা দিতে পারে। এ কারণেই ফসলি জমিতে পোকা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আলোর ফাঁদের গুরুত্ব অশেষ। কেবল প্রচলিত ধারণার উপর নির্ভর করে কীটনাশকের ব্যবহার থেকে কৃষককে দূরে রাখতে এ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে।
Advertisement
আলোক ফাঁদ কী: ফাঁদ হলো কোনো কিছু আটকানোর একটি যন্ত্র। এ যন্ত্রে নানা রকমের কৌশল অবলম্বন করে শিকার ধরা বা আটকানোর ব্যবস্থা করা হয়। ফসলের বেশ কিছু ক্ষতিকর পোকা আছে, যারা আলোতে আকৃষ্ট হয়। তাই এসব পোকা আলোয় আকৃষ্ট করে মেরে ফেলা বা ধ্বংস করার জন্য যে ফাঁদ তৈরি করা হয়, তা-ই আলোর ফাঁদ।
উপকারিতা: আলোক ফাঁদ মূলত পরিদর্শন যন্ত্র, যা দিয়ে ফসলের ক্ষেতে কী কী পোকা আক্রমণ করছে, তা সহজে বোঝা যায়। আলোক ফাঁদ দিয়ে ফসলি জমিতে পোকামাকড়ের উপস্থিতি বোঝা যায়।
পোকাসমূহ: ফসলের শত্রু ও মিত্র সব ধরনের পোকাই আলোতে আকৃষ্ট হয়। বন্ধু পোকার মধ্যে বোলতা, লেগি বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, ড্যামসেল ফ্লাই ইত্যাদি। তেমনি ফসলের বেশ কিছু প্রধান ক্ষতিকারক পোকাও আলোর ফাঁদ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন- ধানের মাজরা পোকা, সাদা পিঠ গাছফড়িং, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং, কমলা মাথা পাতাফড়িং, নলি মাছি, পাতা মোড়ানো পোকা, চুঙ্গি পোকা, থ্রিপস, খাটো শুঁড় ঘাসফড়িং ইত্যাদি। সবজি ফসলের কাটুই পোকা, সরুই পোকা, পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা ইত্যাদিও আলোর ফাঁদ ব্যবহারে দমন করা যায়।
ফাঁদ তৈরির কৌশল: আলোক ফাঁদ তৈরির কলা কৌশল খুবই সহজ। এ ফাঁদ তৈরির খরচও কৃষকের হাতের নাগালে। এ ফাঁদ তৈরি করতে লাগে বৈদ্যুতিক বাতি বা হ্যাজাক বাতি, আবার চার্জার লাইট দিয়েও তৈরি করা যায় এ আলোক ফাঁদ। ফাঁদ তৈরির জন্য ৪-৫ ফুট লম্বা ৩টি বাঁশের টুকরা, গুনা তার, একটি প্লাস্টিক বা মাটির চারি বা গামলা, পানি, সাবানের গুড়া।
Advertisement
৩টি বাঁশের মাথা গুনা তার দিয়ে বেঁধে গোড়া ফাঁক করে তিন দিক দিয়ে তাতে বৈদ্যুতিক বাতি বা হ্যাজাক বাতি সেটিকে দাঁড় করিয়ে দিতে হয়। বাতির নিচে পানিভর্তি গামলা রাখতে হয়। গামলার পানিতে একটু তরল বা গুঁড়া সাবান গুলে দিতে হয়। এতে পোকা পানিতে পড়ে আর উঠতে পারবে না।
বাঁশের মাথায় বাতি ঝুলিয়ে দিলে তার আলোতে পোকা আকৃষ্ট হয়ে এসে পানিতে পড়বে। তবে পানিভর্তি গামলাটি মাটিতে না রেখে কিছুটা উঁচুতে আলোর কাছাকাছি রাখলে পোকা বেশি মরবে। আর এজন্য তিন বাঁশের খুঁটির সাথে আড়াআড়ি ভাবে আরও তিনটি কাঠ বা বাঁশের চটা পেরেক দিয়ে মেরে দিয়ে তার উপরও গামলাটি রাখা যাবে।
লেখক: ডিপ্লোমা কৃষিবিদ ও উদ্যোক্তা।
এসইউ/এএ/জেআইএম