বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে বয়কট করেছে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ১৮টি সংগঠন। এখন থেকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানে জায়েদকে কেউ আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন না, তিনিও কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন না। যে আমন্ত্রণ করবেন, তাকেও একঘরে করবে ১৮ সংগঠন, এমন ঘোষণাই দেয়া হয়েছে।
Advertisement
গত বুধবার (১৫ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের জহির রায়হান কালার ল্যাব মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কাজ না করে ব্যক্তিস্বার্থে নিজের পরিচয় ব্যবহার করছেন।
চলচ্চিত্র পরিবারের দাবি, জায়েদ খান অন্য শিল্পীদের হয়রানি করেন, মিথ্যা মামলার ভয় ও ক্ষমতার দাপট দেখান। তার কাজের সমালোচনাকারীকে সমিতির সদস্যপদ বাতিলসহ নানাভাবে ক্ষতির চেষ্টা করেন।
এদিকে রোববার ১৯ জুলাই দেখা যায় আরেক চিত্র। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন বিএফডিসির গেটের সামনে মিশা-জায়েদের পদত্যাগ চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন শিল্পী সমিতির ভোটাধিকার হারানো ১৮৪ জন শিল্পী। সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় এসব শিল্পী এফডিসির গেটে মানববন্ধন করেন। সেই সঙ্গে ‘যে নেতা শিল্পীদের সম্মান করে না, তাকে আমরা চাই না’ স্লোগান দিয়ে ভোটাধিকার ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি মিশা-জায়েদের পদত্যাগ দাবি করেন।
Advertisement
হঠাৎ করেই শিল্পী সমিতির সভাপতি ও সেক্রেটারির বিরুদ্ধে মানববন্ধন এবং পদত্যাগ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পী ও শিল্পী সমিতির জন্য একটি অপমান ও অসম্মানের ব্যাপার বলে মনে করেন চিত্রনায়ক রিয়াজ। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা সবাই এখন একটু দূরে আছি এফডিসি থেকে। গণমাধ্যমে দেখেছি শিল্পী সমিতির সভাপতি ও সেক্রেটারিকে চলচ্চিত্রের সব সংগঠন মিলে বয়কট করেছে। সেদিন আবার দেখলাম শিল্পীরা পদত্যাগ চাচ্ছে এই দুই শিল্পী নেতার। এটা হতাশার বিষয় আমাদের জন্য।
প্রথম কথা হচ্ছে সবগুলো সমিতি মিলে যখন কোনো একটি সিদ্ধান্ত নেয় কোনো কারণ ছাড়া তো নিশ্চয়ই নেয়নি। কিছু কিছু কারণ আমি গণমাধ্যমের বরাতে জানতে পেরেছি। সেগুলো যদি সত্য হয় তাহলে খুবই আশংকাজনক ব্যাপার এটি চলচ্চিত্রের শিল্পী ও তাদের সমিতির জন্য। একটা অন্ধকার সময় যেন অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়। শিল্পী সমিতি একটি মহান সমিতি। এই সমিতি রাজ্জাক (নায়করাজ রাজ্জাক) আংকেলদের মতো উঁচু মাপের শিল্পীদের হাতে গড়া। অনেক পুরোনো একটি সংগঠন। অনেক ভালো ভালো মানুষ এই সমিতিতে ছিলেন। দীর্ঘদিনের এই সমিতিতে এমন কাণ্ড কখনো ঘটেনি গত ১৯ জুলাই যা ঘটলো। শিল্পীরা তাদের সভাপতি ও সেক্রেটারির পদত্যাগ চাইলো। এটা আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। শিল্পীদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে বলেই তারা আজ রাস্তায় নেমেছে।’
‘যখন ১৮৪ জন শিল্পীকে বাতিল করা হলো তখন আমি নিজেও কমিটিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলাম। আমি এর সাক্ষী। এদের অন্যায়ভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা কয়েকজন যখন ব্যাপারটি নিয়ে কথা বলতে চাইলাম তখন এই দুজনের সঙ্গে অনেক বাদানুবাদ হয়েছিল। আমাদের বলতে দেয়া হয়নি কোনো কথা। স্পষ্ট দেখছিলাম সবাইকে অন্ধকারে রেখে কেউ কেউ স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসব কারণেই কিন্তু আমি আর পরে তাদের সঙ্গে নির্বাচনে যাইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে যদি নিজের কমিটির অনিয়মকেই রুখতে না পারি তাহলে আর পদে থাকার দরকার নেই। একটা বিষয় কি, যে কোনো পদেই ভালো মানুষদের থাকা উচিত। কারণ তাদের হাতে অনেকের দায়িত্ব থাকে। এসব কারণেই সরে এসেছিলাম। আর ইলেকশন করিনি। আরও অনেকেই সরে এসেছেন যারা এদেশের চলচ্চিত্রের প্রথম সারির এবং যথেষ্ট সম্মানিত ও দর্শকপ্রিয় তারকা’- যোগ করেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এ নায়ক।
তিনি আরো বলেন, ‘একবার ভাবুন, এই করোনার ক্রান্তিকালে তারা রাস্তায় নেমেছেন। মানববন্ধন করেছেন। পরিস্থিতি কি পর্যায়ে গেলে তারা এমন আতঙ্কের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদেরই নেতাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন! আমার কাছে খুব কষ্ট লেগেছে সবদিক থেকেই। শিল্পীদের জন্য এটি কাম্য নয়, নেতাদের জন্যও নয়। আমি চাই যেভাবেই হোক সমিতি ও শিল্পীরা ভালো থাকুক। কিন্তু তা হচ্ছে না, এটা স্পষ্ট। আমার কাছে মনে হয়েছে যেসব দাবিতে শিল্পীরা আজ রাস্তায় তার সবগুলোই যৌক্তিক। শুধু সভাপতি আর সেক্রেটারি নয়, পুরো ২১ জনকে নিয়ে একটি ক্যাবিনেট হয়। ২১ জনের মধ্যে ওই দুজন ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে কিন্তু কথা উঠছে না। কেন? আমি জানি না কেন। তবে কোনো কারণ ছাড়া যে হচ্ছে না সেটা তো বোঝাই যায়।’
Advertisement
মিশা সওদাগর ও জায়েদ খানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বয়কটের ডাক দেয়ায় অনেক শিল্পীই প্রতিবাদ করছেন। বিশেষ করে শিল্পী সমিতির নেতৃত্বে থাকা অনেকেই এই দুই নেতার পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্র অভিনেতা ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুকও তার অনুজ দুই শিল্পীর পাশে রয়েছেন। তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমে তাদের বয়কট করার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘শিল্পীদের কোনো দিন বয়কট করা যায় না। তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে’।
তার এই কথার প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছে নতুন সমালোচনা। ২০১৭ সালে চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক হিসেবে নানা অনিয়ম ও চলচ্চিত্রের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় চিত্রনায়ক শাকিব খানকে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন অভিনেতা ফারুকই। আজ যখন মিশা-জায়েদকে বয়কট করা হচ্ছে তখন তিনি কেন শিল্পীদের বয়কট করা যায় না বলে দাবি করছেন। তবে কি শাকিব শিল্পী নন? এমন প্রশ্নও ছুড়েছেন চলচ্চিত্র পরিবারের অনেকে। এ বিষয়ে চিত্রনায়ক রিয়াজ বলেন, ‘এটি আমার কাছে আহত হওয়ার মতোই একটি বিষয়। মিয়া ভাই আমাদের কাছে সম্মানিত ব্যক্তি। আমাদের সবার ভালোবাসার মানুষ তিনি। বর্তমান সংসদ সদস্য হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। উনি যখন কথা বলেন তখন সেটা নিয়ে সমালোচনা বা কাউন্টার কিংবা পরামর্শ বলুন, কোনোটাই দিতে পারি না আমি।
তিনি আমার মুরুব্বি, ইন্ডাস্ট্রির মুরুব্বি। একজন শক্তিমান অভিনেতা। তিনি যা জানেন বা বোঝেন আমি ততোটা নই। অল্প সময়ের ব্যবধানে মিয়া ভাইয়ের কাছে দুই ধরনের বক্তব্য শুনে হতাশ হয়েছি। আমার ধারণা ইন্ডাস্ট্রির সবাই হতাশ হয়েছেন, অবাক হয়েছেন। এছাড়া এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে আমি বিব্রতবোধ করেছি। হয়তো তিনি নিজেও ভাবছেন নিজের কথাগুলো নিয়ে। তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং বিচক্ষণ মানুষ।’
দিনশেষে চলচ্চিত্রে শিল্পের সব অস্থিরতা কেটে যাক এমনটাই প্রত্যাশা করছেন রিয়াজ। তার মন্তব্য, ‘ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন ইন্ডাস্ট্রির মঙ্গলের জন্য কাজ করুক। যখন কেউ নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পায় তার উচিত তার সংগঠনের স্বার্থে ত্যাগী হওয়া, বিনয়ী হওয়া, পরিশ্রমী হওয়া। নাম-পরিচয় কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার একেবারেই কাম্য নয়। সবাই মিলেমিশে এখন সিনেমার সুদিন ফেরানোর চেষ্টা করা উচিত। সরকার তো নানাভাবেই আমাদের পাশে রয়েছে। আমরা তাহলে কেন পারছি না, সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।’
এলএ/এমকেএইচ