মতামত

জনস্বাস্থ্যের উন্নতি বিধানে নিতে হবে সমন্বিত পরিকল্পনা

সারাবিশ্ব এখন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংক্রামক রোগ বিশ্বব্যাপী অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল বেশ কিছুটা সময় ধরেই। বিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতির কারণেই যদিও বিশ্বের নানাপ্রান্তে মাঝেমধ্যে এদের আবির্ভাব ঘটে কিন্তু তা আবার চলেও যায়। অথবা কোথাও কোথাও সেটা স্থানীয় সংক্রমণ হিসেবেই রয়ে যায়।

Advertisement

তবে, করোনার শুরু এবং তার বিস্তার হয়েছে অভাবনীয় গতিতে। আমাদের এখানেও ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ার পর থেকে ২ মাসের ছুটি শেষে জুনের ১ তারিখ থেকে সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। একটা ঈদ পার করেছি আমরা। এ মাসের শেষে কোরবানির ঈদ আসছে। মানুষ কি বিদ্যমান বাস্তবতায় দল বেঁধে ঈদ করতে গ্রামে যেতে পারবে? নাকি যেতে দেয়া ঠিক হবে?

এবার শহর থেকে দলে দলে লোক ঈদে গ্রামে গেলে আগস্টে আমরা গ্রামকেন্দ্রিক করোনার বিস্তার দেখতে পাব। যদিও অনেক গ্রামে এখনও করোনার বিস্তার ঘটেনি। ঈদে মানুষজন বাড়িতে গেলে এসব গ্রাম জনপদও ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তাতে আক্রান্তের হারের সাথে সাথে মৃত্যুও বাড়বে। এর বড় কারণ হচ্ছে, উপজলা তে তো নেই ই; এমন কি জেলা সদরের হাসপাতালগুলোতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই এর ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। ফলে অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে তখন এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

আমাদের সংবিধানের ১৮ এর ১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে " জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন"। আর ১৬ অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে অন্যান্য আরো কিছু বিষয়ের সাথে "জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের" কথা বলা হয়েছে। ফলে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের বিষয় কিন্তু আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের সাথেই জড়িত। কিন্তু সেদিকে আমাদের নজরদারি বা কর্মতৎপরতা কতটা? এতদিনে আমরা কতটাই বা করতে পেরেছি- সে প্রশ্নও নিশ্চয় সামনে এসে যায়।

Advertisement

জনস্বাস্থ্যের উন্ময়নের জন্য মূলত আমাদেরকে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। এত দিন না বুঝে যা করেছি তা তো করেছিই। এখন তো আমরা বুঝে গেছি যে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সে অর্থে কোন টেকসই ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে নেই। ফলে সংবিধান নির্দেশিত ও প্রতিশ্রুত "জনস্বাস্থ্য" নামক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবেই। না হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

"জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন" এর প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে জনগণকে তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন করে তোলা। তাদেরকে তাদের প্রাপ্য বুঝে নিতে উৎসাহিত করা। আমাদের দেশে এখন সংক্রামক রোগের চেয়ে অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার হু হু করে বেড়েই চলেছে। এসব রোগ একবার হয়ে গেলে তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া খুবই ব্যয়বহুল বিষয়। অনেকের পক্ষেই তা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।

অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে রোগের চিকিৎসা শুরু করলেও পরে তা আর চালিয়ে নিতে পারে না। কারণ আমাদের দেশে চিকিৎসার ৭০% ই যায় ব্যক্তির পকেট থেকে। কয়জন মানুষ এ আর্থিক চাপ নিতে পারবে বলুন তো? পারে না বলেই ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরে পথের ফকির হয়ে যায় অনেকেই। বছরের পর বছর ধরে এ অবস্থা চলছে। আর কত এভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা চলবে বলুন তো? ব্যবস্থাগত পরিবর্তন তাই এখন সময়ের দাবি। এটা করতেই হবে। কারণ এর কোন বিকল্প নেই।

দেখুন, অসংক্রামক রোগ কিন্তু সংক্রামক রোগের মতোই আমরা সহজেই প্রতিরোধ করতে পারি। তাতে করে নীরোগ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। ফলে হাসপাতালের উপরেও চাপ কমবে।পরিবারগুলো ভালো থাকবে। এর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট লাগবে না কিন্তু। প্রয়োজন হবে শুধু-

Advertisement

(১) সচেতনতা সৃষ্টি। যাদের এ রোগগুলো হয় নি তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আর যাদের হয়ে গেছে তাদেরকে নিয়মিত চেক আপের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় নেতা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী তাদেরকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে কিন্তু এটা করা কোন ব্যাপারই না।(২) জনস্বাস্থ্যের স্বার্থবিরোধী ভেষজ ওষুধ, টোটকা বা এ জাতীয় নামে প্রচলিত অপরীক্ষিত ওষুধের ব্যবহার বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।(৩) দেশে ভেজাল ওষুধের কারখানা, ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে জেল জরিমানা শুধু নয়; একদম বন্ধ করে দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কোনো ছেলেখেলা কাম্য নয়।(৪)রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে। সরকারি চাকরিতে ডাক্তার আছেন ২০৯১৪ জন (২০১৯ এর হিসেব)। এখন অবশ্য আরো কিছু নিয়োগ হয়েছে। আর আমাদের দেশে মোট সক্রিয় ডাক্তারের সংখ্যা ৭৬, ৮৬৭ জন। আমাদেরকে এ সকল ডাক্তার এবং বছর বছর যারা পাস করে বের হবেন তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে রেফারেল সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে হলে আগে রেজিস্টার্ড ডাক্তারকে দেখিয়ে আসতে হবে। রেফার ছাড়া কেউ ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলা, বিভাগ, মেডিকেল কলেজ বা বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি হতে বা চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে না। এতে হাসপাতালে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর ভিড় কমবে।রোগীরা গুণগত সেবা পাবেন।

(৫) নার্স, ফিজিওথেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট, প্যারামেডিক, টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিতে হবে একদম ইউনিয়ন থেকে শুরু করে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে।(৬) আমাদের দেশে "মানসিক স্বাস্থ্য" কে গুরুত্বহীন মনে করা হয়ে থাকে।এজন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করতে হবে। এ সাবজেক্টে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েদেরকে উৎসাহিত করতে হবে।(৭) কম দামী অথচ পুষ্টিকর- এমন খাবার খেতে জনগনকে উৎসাহিত করতে হবে। শাকসবজি, দেশীয় ফলমূল বিষমুক্ত উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে।

আরো অনেক কিছুই এর সাথে যুক্ত হতে পারে। সেসব একত্রিত করে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে একটা সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমাদের খুবই দরকার। কারণ এটা আমাদের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতিরই অংশ।

লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/এমকেএইচ