ব্রিটেনের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে গুরুতর অবনতি দেখা যাচ্ছে। অথচ মাত্র বছর পাঁচেক আগেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ‘সোনালি দশকের’ কথা বলছিল ব্রিটেন। কেন এই সম্পর্কে এত নাটকীয় মোড়?
Advertisement
ইংল্যান্ডের বাকিংহ্যামশায়ারের ছোট্ট এক গ্রামের সুন্দর একটি পাব বা পানশালার নাম ‘দ্য প্লাউ এট ক্যাডসডেন।’ ব্রিটেনে প্রতি বছর যে হাজার হাজার চীনা পর্যটক আসেন, তাদের অনেকের বেড়ানোর তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছে এই পাবটি।
বাকিংহ্যামশায়ারের এই পাবের খুব কাছেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এক সরকারি বাড়ি। চেকার্স নামের এই বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী সাধারণত অবকাশ যাপনে যান, কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ণ অতিথিকে আপ্যায়ন করেন।
দু’হাজার পনের সালের অক্টোবরে দেশটিতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার অতিথিকে নিয়ে গেলেন ‘দ্য প্লাউ এট ক্যাডসডেনে’। সেখানে তারা দু’জনে গল্প করতে করতে বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন, সেই ছবি পরদিন ছাপা হলো সারা দুনিয়ার পত্রিকায়। ‘দ্য প্লাউ এট ক্যাডসডেন’ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। এতটাই বিখ্যাত যে, চীনা পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠলো এই পানশালাটি।
Advertisement
পরের বছর একটি চীনা কোম্পানি ‘সাইনোফরটোন’ এটি কিনে নিল। এটি একটি বিশাল বড় কোম্পানি। তারা নাকি ভবিষ্যতে ব্রিটেনে একটি পাব চেইন খোলার পরিকল্পনা করছে। চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের যে স্বপ্ন থেকে চীনা প্রেসিডেন্টকে ব্রিটেন এত উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছে, মনে হচ্ছিল যেন সবকিছু সেভাবেই আগাচ্ছে।
‘সোনালি দশক’
‘‘ব্রিটেন আর চীনের সম্পর্কে এক ‘সোনালি দশক’ শুরু হতে যাচ্ছে”- সে বছরই চীন সফরে গিয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের সেই সোনালি দশক কয়েক বছর না যেতেই এক তিক্ত শীতল যুদ্ধের দিকে গড়িয়েছে। রাজনীতি আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এ সপ্তাহই নাকি অনেক দীর্ঘ সময়। পাঁচ বছর তো সেখানে আরও অনেক অনেক দীর্ঘ।
এই পাঁচ বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে নাটকীয় সব পরিবর্তন ঘটে গেছে। ব্রেক্সিট, অর্থাৎ ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পথ ধরে চীন-মার্কিন সম্পর্কে অবনতি এবং বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। হংকং এ গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ দমনে বেইজিং নিয়েছে কঠোর অবস্থান। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কিছু পশ্চিমা দেশ এই কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সর্বশেষ তাদের কাতারে গিয়ে সামিল হয়েছে ব্রিটেন।
Advertisement
সম্পর্ক মোড় নিল যেভাবে
জর্জ অসবোর্ন যখন ব্রিটিশ-চীন সম্পর্কে সোনালি যুগের স্বপ্ন দেখছিলেন, তখন ব্রিটেনের রাজনীতি আজকের মতো এতটা জটিল হয়ে উঠেনি। ডেভিড ক্যামেরন দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন তার নেতৃত্বে কনজারভেটিভ পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হওয়ার পর। ব্রিটেন তখন চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য উন্মুখ। একদিকে একশো কোটির বেশি মানুষের এক বিশাল বাজারের সঙ্গে বাণিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা, অন্যদিকে বিপুল চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা।
বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চীন ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’ নামে যে আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি করছে, ব্রিটেন সে বছরই সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এতে নাখোশ হয়েছিল। কারণ ব্রিটেন ছিল জি-সেভেন গোষ্ঠীর প্রথম দেশ, যারা চীনের এই কাজে সায় দিল। চীনের সঙ্গে ব্রিটেনের এই ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা ওয়াশিংটনে যথেষ্ট অস্বস্তি তৈরি করছিল।
কিন্তু সে সময়ের কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে ছিল তাদেরই প্রাধান্য, যারা চীনের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী ছিলেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন ব্রিটেনের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে চীন সফরে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, পশ্চিমের আর কোন দেশের অর্থনীতি চীনের জন্য এতটা উন্মুক্ত নয়, যতটা উন্মুক্ত ব্রিটেন।
জর্জ অসবোর্ন চেয়েছিলেন, চীনের ব্যাংকিং সেক্টরে সিটি অব লন্ডনের ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ, আর অন্যদিকে উত্তর ইংল্যান্ডের সাবেক শিল্প শহরগুলোতে বেশি করে চীনা বিনিয়োগ। কিন্তু তারপরই ব্রিটেনে, যুক্তরাষ্ট্রে এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নাটকীয় সব ঘটনা ঘটতে শুরু করলো।
দু’হাজার ষোল সালের গণভোটে ব্রিটেন ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিল। গণভোটে হেরে একদিন পরেই পদত্যাগ করে বসলেন ডেভিড ক্যামেরন। ব্রেক্সিটের পর একই রকম নাটকীয় ফল দেখা গেল সে বছরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর কূটনীতিতে যে বিরাট প্রতিঘাত তৈরি করলো- তাতে চীন-ব্রিটেন সম্পর্কের ‘সোনালি দশকে’র স্বপ্ন যারা দেখেছিলেন, তাদের সেই স্বপ্ন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
ব্রিটেন আর চীনের মধ্যে বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। ব্রিটেনের বাজার চীনা কনজুমার পণ্যে সয়লাব। চীন থেকে বিপুল পণ্য আমদানি করে তারা। এর পাশাপাশি গত এক দশকে চীনে ব্রিটেনের রফতানি বেড়েছে তিনগুন। একই সঙ্গে ব্রিটেনে বেড়েছে চীনের বিনিয়োগ। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষা নিতে আসে হাজার হাজার চীনা ছাত্র-ছাত্রী। বলা হয়ে থাকে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এই চীনা ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে, তারা না আসলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বড় আর্থিক সংকটে পড়বে।
কিন্তু এই ব্যাপক বাণিজিক সম্পর্ক সত্ত্বেও ব্রিটেনের রাজনীতিতে চীনের ব্যাপারে একটা পরিস্কার বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি পক্ষ চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে আগ্রহী। তারা মনে করে ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের খুবই প্রয়োজন চীনের মত এক বিরাট বাজার এবং অর্থনৈতিক শক্তিকে। অন্যদিকে আছে আরেকটি গোষ্ঠী- যারা মনে করে চীনকে মোটেই বিশ্বাস করা উচিৎ নয় এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রতিটি পর্যায় জাতীয় নিরাপত্তার নিরিখে যাচাই করে দেখা দরকার।
বিবিসির রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেমস ল্যান্ডেল মনে করেন, পার্লামেন্টে এমপিদের মধ্যে চীন বিরোধী মনোভাব শক্ত হচ্ছে। এর একটা কারণ করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে চীনে যা ঘটেছে। দ্বিতীয় কারণ, হংকং এর ব্যাপারে চীন যে ধরনের নীতি নিয়েছে।
জেমস ল্যান্ডেল বলছেন, চায়না রিসার্চ গ্রুপ নামে এমপিদের একটি গোষ্ঠী চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। ডানপন্থী একটি থিংক ট্যাংক পলিসি এক্সচেঞ্জের ডিন গডসন বলছেন, কনজারভেটিভ পার্টির বিভিন্ন উপদল এখন চীন প্রশ্নে এককাট্টা হচ্ছে। এর পাশাপাশি আছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ।
ব্রিটেনের ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে হুয়াওয়েইকে কাজ না দেয়ার যে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নিয়েছেন, তার পেছনে এসব চাপ কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।
হংকং নিয়ে উত্তেজনা
দু’দেশের সম্পর্কে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আরও উত্তেজনা তৈরি হয় হংকং নিয়ে। হংকং ব্রিটেনের এক সাবেক উপনিবেশ। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন এটি চীনের কাছে ফিরিয়ে দেয়। কিন্ত তখন চুক্তি হয়েছিল, ‘ওয়ান কান্ট্রি, টু সিস্টেম’ নীতি অনুযায়ী হংকং পরিচালিত হবে। অর্থাৎ হংকং চীনের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেখানে পুঁজিবাদী নীতিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাও হবে পৃথক।
বহাল থাকবে হংকং এর নিজস্ব আইন কানুন। থাকবে জনসমাবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। চীন আর ব্রিটেনের এই চুক্তি ২০৪৭ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার কথা। কিন্তু হংকং এ জারি করা নতুন নিরাপত্তা আইনের ফলে এই চুক্তি এখন হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করে ব্রিটেন।
ব্রিটেন-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
তবে ব্রিটেনে চীনের পক্ষেও আছে শক্তিশালী একটি মহল, যারা মনে করেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী বিশ্বে চীনের সঙ্গে একটি বাস্তবভিত্তিক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। ড. টিম সামার্স চ্যাথাম হাউসের এশিয়া-প্যাসিফিক কর্মসূচীর সিনিয়র ফেলো। তিনি মনে করেন, ব্রিটেনের চীন সম্পর্কিত নীতির মূল ভিত্তি হওয়া উচিৎ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বৈরিতা নয়।
চ্যাথাম হাউসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ড. টিম সামার্স লিখছেন, ‘যুক্তরাজ্যের জন্য চীন কোন সামরিক বা বড় নিরাপত্তা হুমকি নয়, প্রতিযোগীও নয়। চীন বরং ব্রিটেনের একজন পার্টনার, সম্ভাব্য পার্টনার, যারা এক সঙ্গে বিশ্বের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। চীন বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করছে, বিশেষ করে যখন তাদের অর্থনীতি নীচের পর্যায়ের ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে ক্রমশ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বিরাট বাজার এবং সেবা ভিত্তিক অর্থনীতির দিকে উত্তরণ ঘটাচ্ছে’।
ড. সামার্স বলছেন, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা চীনের ব্যাপারে হয়তো কৌশলগত বিষয়গুলোকেই গুরুত্ব দিতে বলবে। কিন্তু ব্রিটেনকে এখানে সোজা-সাপ্টা অবস্থান নিতে হবে, এমন কোন কথা নেই। ব্রিটেনের উচিৎ বাস্তব অবস্থার নিরিখে তার নীতি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা/এমআরএম