>> বিশ্বব্যাংকের ‘সহজে ব্যবসা সূচকে’ পিছিয়ে দেশ>> পিছিয়ে রয়েছে ট্যাক্স, ভ্যাট, জমি প্রদানের ক্ষেত্রেও >> পিছিয়ে থাকলেও আশা ছাড়ছেন না বাণিজ্যমন্ত্রী
Advertisement
বৈশ্বিক করোনাভাইরাস (কোভিড- ১৯) মহামারির কারণে একদিকে যেমন জীবন-জীবিকার ঝুঁকি বেড়েছে, অন্যদিকে সম্ভাবনারও উঁকি দিয়েছে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। করোনার উৎপত্তিস্থল চীন ছাড়তে চাচ্ছেন অনেক ক্রেতা ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা এখন বিকল্প উৎস দেশ খুঁজছে। অর্থাৎ তিন দশক ধরে ‘উৎপাদনকেন্দ্র’ হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পাওয়া চীন থেকে বিনিয়োগ অন্যত্র স্থানান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এমন মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়াও করতে রাজি নয় কেউ।
চীন থেকে মুখ ফেরানো বিদেশি এই বিনিয়োগ নিজেদের দেশে টানতে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশসহ অনেক দেশ। তবে বিনিয়োগ-উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে হাল ছাড়তে রাজি নয় সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়— তা নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথমটি।
Advertisement
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সভা করেছে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সামগ্রিক কর্মকৌশল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এ বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য গঠিত কমিটি।
সভার কার্যপত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশে করপোরেট ট্যাক্স হার বর্তমানে ৩৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে করপোরেট ট্যাক্স হার ২০ শতাংশ। ভারতে সম্প্রতি আগের করহার ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২২ শতাংশ করা হয়েছে; তবে শিল্প খাতের নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য এ হার ১৭ শতাংশ।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টের ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্স হারের ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের স্বার্থে প্রতিযোগী দেশসমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করহার হ্রাস করা প্রয়োজন বলে মনে করছে কমিটি।
এদিকে অনগ্রসর এলাকায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উৎপাদনের প্রথম ১০ (দশ) বছরের জন্য শতভাগ কর অব্যাহতি প্রদান করেছে ভিয়েতনাম। তবে বাংলাদেশ সেভাবে কর অব্যাহতির ঘোষণা দিতে পারেনি।
Advertisement
কমিটি বলছে, বর্তমানে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে স্থাপিত কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে ২০ শতাংশ হারে নগদ ভর্তুকি প্রদান করা হয়। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অঞ্চলের দেশীয় মালিকানায় স্থাপিত কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ৪ শতাংশ নগদ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিদেশী ও যৌথ বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা দেয়া হয়নি। এটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সামগ্রিক দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
কার্যপত্রে আরও বলা হয়, বর্তমানে দেশে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) হার ১৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে ভিয়েতনামে ৭ শতাংশ এবং কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডে ১০ শতাংশ। বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট মূল্য সংযোজন করের হার হ্রাস তথা পুনর্নির্ধারণ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কমিটি আরও বলছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ২৭ কারখানাকে সম্পূর্ণ ফ্রি চার হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার, সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে হলে জমি কিনতে হবে বিদেশিদের। তার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে কোনো ধরনের ভ্যাট প্রদান করতে হয় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছে কমিটি।
এদিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ভারতে বিদেশিরা বিনিয়োগ করে পাঁচ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। ইন্দোনেশিয়ায় দুই হাজার ৩৪২ এবং ভিয়েতনামে এক হাজার ৬১২ কোটি ডলার। বাংলাদেশে আসে মাত্র ১৫৯ কোটি ডলার। এই তিন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য যেন আকাশ-পাতাল।
কেন এত পিছিয়ে বাংলাদেশ? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক বিষয় জড়িত। তবে বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' বা ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ সূচকের মাধ্যমে বিষয়টি সহজেই পরিষ্কার হওয়া যায়। সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে ১৬৮তম। যেখানে ভারত ৬৩, ভিয়েতনাম ৭০ এবং ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান ৭৩তম। অর্থাৎ বাংলাদেশের তুলনায় এসব দেশের ব্যবসার পরিবেশ অনেক ভালো। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগও কম।
আঙ্কটাডের হিসাব অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে এ বছর বিশ্বব্যাপী বিদেশি বিনিয়োগ ৪০ শতাংশ কমতে পারে। করোনা-পরবর্তী বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ। রয়েছে বাংলাদেশও। শুরু হয়েছে নীতিনির্ধারণও। প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশের গতি সন্তোষজনক নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ইতোমধ্যে কৌশল নির্ধারণ শুরু করেছে ভারত সরকার। দেশটিতে দেশি-বিদেশি বিয়োগকারীদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ একর জমি। শিথিল করা হয়েছে শ্রম আইনের শর্ত, পরিকল্পনা হচ্ছে করছাড় দেয়ার। রাজ্যগুলোও নিচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থা। এরই মধ্যে প্রায় এক হাজার কোম্পানিকে ভারতে আসার প্রস্তাব দিয়েছে মোদি সরকার।
বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ইতোমধ্যে বড় সফলতা পেয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার। চীন থেকে মার্কিন কারখানা সরিয়ে নিতে সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই প্রস্তাব দিয়েছে জাকার্তা। বরাদ্দ করেছে চার হাজার একর জমি। জাকার্তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ২৭টি কারখানা সরানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসন। প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো জানিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার জায়ান্ট এলজিও চীন থেকে কারখানা সরিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় আসছে।
এদিকে বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারিতে ইউরোপ-আমেরিকা নাকানি-চুবানি খেলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ভিয়েতনাম। স্থানান্তরিত হওয়া এসব বিনিয়োগ টানতে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে দেশটি। বিনিয়োগ আকর্ষণে স্পেশাল টাস্কফোর্স করেছে তারা। লক্ষ্য, মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্প্রতি হওয়া মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হ্যানয়ের অন্যতম শক্তি। ফলে চীনের অনেক পোশাক কারখানারও বিনিয়োগ পাওয়ার আশা করছে দেশটি।
বিদেশি বিনিয়োগের তেমন কোনো আশ্বাস না পেলেও বসে নেই বাংলাদেশ। জাপানি বেশকিছু বিনিয়োগ পাওয়ার আশা করছে সরকার। বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানির করপোরেট কর কমানো হয়েছে আড়াই শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নীতিতে পরিবর্তনে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি বাস্তবায়ন হলে বৈদেশিক মুদ্রা বা এফসি অ্যাকাউন্ট খুলে লাভের টাকা রাখতে, বিনিয়োগ করতে এবং ফেরত নিতে পারবেন বিদেশিরা।
এসব বিষয়ে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। করোনা-পরবর্তী বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম একটি সেট কান্ট্রি, তারা ইকোনমির বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অনেক আগে থেকেই তারা পলিসি পরিবর্তন করে। তাই ভিয়েতনাম এ পথে অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়াও এ সুযোগ নেয়ার জন্য বেশ আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে। তাদের অনেক জনবল রয়েছে, সামাজিক অবস্থাটাও তাদের ভালো। এসব বিবেচনায় তারাও এগিয়ে রয়েছে। তবে আমরাও বিনিয়োগ আকৃষ্টে কাজ শুরু করেছি। আমাদের দেশেও বিদেশি বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পলিসি চেঞ্জ হচ্ছে। আশা করি, এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে এসব ক্ষেত্রে বড় একটা পরিবর্তন আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে ইতোমধ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই আমরা বৈঠকে বসব। যদিও আমরা একটু ধীরগতিতে রয়েছি, তারপরও আশাবাদী যে, আমরাও সঠিক পথে এগোচ্ছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও ইতোমধ্যে প্রসেস শুরু করেছে। সবদিক থেকে কাজ শুরু হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে প্রতিযোগী দেশগুলো কী কী সুবিধা দিয়েছে, সেসব পয়েন্ট নিয়ে আমরাও কাজ করছি।’
এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে আমরাও কাজ করছি। এখনও বলার মতো তেমন অগ্রগতি হয়নি। আশা করছি, অল্পকিছু দিনের মধ্যেই অগ্রগতি আসবে।’
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয় সে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিনিয়োগকারীরা যাতে তাদের অর্থ-লভ্যাংশ সহজে নিজ দেশে বা অন্যত্র নিয়ে যেতে পারেন, সেজন্য ব্যাংকিং জটিলতা কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় বলছে, বিনিয়োগের অর্থ-লভ্যাংশ নিজ দেশে সহজে প্রত্যাবর্তন তথা নিজ দেশ বা অন্য কোনো দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির অন্যতম শর্ত। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে অনায়াসে বিনিয়োগের অর্থ-লভ্যাংশ নিজ দেশ বা অন্যত্র নিয়ে যেতে পারেন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা কর্তৃক জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ব্যাংকিং কার্যক্রমে নিয়মনীতি সহজীকরণ বা যুগোপযোগীকরণ এবং তার বাস্তব প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে।
এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭-কে বাংলা ভাষায় রূপান্তর এবং যুগোপযোগী করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এটিকে জাতীয় সংসদে পাস করিয়ে আইনে পরিণত করার কাজ দ্রুতগতিতে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এমইউএইচ/এমএআর/এমএস