বিশেষ প্রতিবেদন

বিদেশে থেকেও অনেক সাহেদ ভূমিকা পালন করছে

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। করোনা পরিস্থিতি ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দীর্ঘ আলোচনায় নৌ ও নৌ-পথের উন্নয়ন এবং সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব পায়।

Advertisement

সরকার ডেলটা প্ল্যানের মাধ্যমে যে উন্নয়নের রূপরেখা দাঁড় করিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ হিসেবে ফের উজ্জীবিত হবে দেশ— এমন আশাবাদও ব্যক্ত করেন। আলোকপাত করেন করোনাকালে উপ-নির্বাচন প্রসঙ্গে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত মানুষ। সমাজ, অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে। সরকার পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। এমন সময়ে সাহেদকাণ্ড অবাক করেছে কি-না?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : সাহেদের ঘটনা কি আসলে অবাক করার বিষয়? কারণ এমন দুর্বৃত্তরা একদিনে তৈরি হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সবারই জানা। একটি স্বাধীন দেশকে বঙ্গবন্ধু মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। ওই সময় জিডিপির হার ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। যা পরবর্তীতে আর দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই রেকর্ড ভাঙছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি জাতিসত্তাকে হত্যা করা হয় এবং পাকিস্তানি ভাবধারা পুনরায় প্রতিষ্ঠা পায়। এই ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই দুর্বৃত্তায়নের সৃষ্টি। মূলত, সাহেদরা তখন থেকেই তৈরি হতে থাকে।

Advertisement

সাহেদরা একদিনে তৈরি হয়নি। অনেক সাহেদ-ই আছে, যাদের আমরা ধরতে পারি না। মুখোশ পরে বিভিন্ন জায়গায় গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে। তারা সমস্ত সুন্দরকে অসুন্দর করে দেয়। সাহেদ তেমনই এক চরিত্র

জাগো নিউজ : বলছিলেন, ‘অনেক সাহেদ-ই আছে, যাদের আমরা ধরতে পারি না।’ না ধরতে পারার কারণ কী?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : ’৭৫ পরবর্তী দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে পুরো সমাজব্যবস্থাই পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থা আপনি চাইলেই রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারবেন না। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল, গণতন্ত্রকে আড়াল করে দেশ চালানো হয়েছিল। এমন সমাজে সাহেদদের লুকিয়ে থাকার অনেক জায়গা আছে।

সেই সমাজব্যবস্থা পেছনে ফেলে আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যদি বলে দেই, আজ থেকে বিচার বিভাগ স্বাধীন। তার মানেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যাবে? এই স্বাধীনতার সুফল পেতে একটি চর্চার বিষয় আছে। আমরা সেই চর্চার চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের অর্থনীতির মধ্যে দুর্বৃত্তায়ন আছে, এটি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেই অর্থনীতি কাদের হাতে ছিল, তা বিবেচনায় নিতে হবে। দেশবিরোধী শক্তি অর্থাৎ জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকার দুর্নীতিবাজদের হাতে অর্থনীতি তুলে দিয়েছিল। এমন ব্যবস্থা থেকে বের হতে পারিনি বলেই সাহেদদের বিচরণ এখনও আছে।

Advertisement

জাগো নিউজ : সাহেদের বিচরণ ছিল বঙ্গভবন থেকে গণভবনে। মুজিবকোট পরে রাষ্ট্র, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি…

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : দেখুন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সাহেদের কাছে যায়নি। সাহেদরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসে নিজেদের জায়েজ করার চেষ্টা করেছে।

জাগো নিউজ : কিন্তু জায়গা তো দেয়া হচ্ছে। এই প্রশ্নে বিচক্ষণতার ঘাটতি আছে কি-না?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : বিচক্ষণতার প্রশ্ন নয়। ঘাটতি হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির মধ্যে। সাহেদরা ক্ষতি করছে— এই প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমরা তাদের চিহ্নিত করতে পারছি কি-না? আগে কিন্তু সাহেদদের এভাবে চিহ্নিত করা বা গ্রেফতার করা হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি। আগে সে চেষ্টাই হয়নি।

সরকার বা দল সাহেদদের মতো ব্যক্তিদের কোনোভাবেই ধারণ করেনি

জাগো নিউজ : স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ-ই অধিক সময় ক্ষমতায় থাকল। বিশেষ করে ২০০৮-এর পর তিনবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায়। এটি কি যথেষ্ট সময় নয়?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : না। এটি যথেষ্ট সময় নয়। ২০০৮ সালে দেশরত্ন শেখ হাসিনা যখন ফের সরকার গঠন করেন তখন দেশের অর্থনীতি ছিল একেবারেই ভঙুর। আইনের শাসনের বালাই ছিল না। ক্ষমতা নেয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় পিলখানা হত্যাকাণ্ড দেখতে হয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে বিচার হচ্ছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্ত চ্যালেঞ্জ পায়ে মাড়িয়ে সে বিচার সম্পন্ন করে চলছেন। আমরা যুদ্ধাপরাধ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছি। এই বিচারগুলো কিন্তু খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

গত ১১ বছরে এসব বড় বড় বিচার করতে হয়েছে। আমরা এই সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছি। এই ১১ বছরে আমাদের জিডিপি ৮ শতাংশের ওপরে। এই সময়ে বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়েছে। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছি।

২০০৮ সালের পর থেকে আমরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা তৈরি করতে পেরেছি। সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি নির্মূল করেছি। এই সময় সংসদ অধিক মাত্রায় কার্যকর। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশ নিয়ে গোটা বিশ্ব বিস্ময় প্রকাশ করছে।

শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার মান বেড়েছে। ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুৎ। সামাজিক নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তায় আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ এখন লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে পারে। সমুদ্রসীমা, ছিটমহল সমস্যার সমাধান কিন্তু এই সময়েই হলো। এসব অর্জন তো অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের অর্জন অনেক, সেখানে সাহেদকাণ্ড বড় ঘটনা নয়।

বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পাচ্ছে, বর্তমান সরকার সাহেদদের পক্ষে নয়। সাহেদদের পক্ষে কি একজন মানুষও দাঁড়িয়েছে? সাহেদকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তার অপকর্ম চিহ্নিত করা হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের পর সাহেদদের বিচরণের জন্য রাস্তা করে দেয়া হয়েছিল। যে কারণে এমন সাহেদ বহু আছে। আবার বিদেশে থেকেও অনেক সাহেদ ভূমিকা পালন করছে। আমি মনে করি, সব সাহেদকাণ্ডই সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র।

জাগো নিউজ : অভিযোগ উঠছে, সাহেদ, সম্রাট, পাপিয়াদের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছেন, এই কারণে দুর্নীতির এমন ব্যাপকতা...

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : সাহেদরা মুখোশধারী। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদে খন্দকার মোশতাকের মতো ব্যক্তি ছিল। মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে খুনের নেতৃত্ব দেবে— কেউ কি ভেবেছিল?

তবে সাহেদদের গডফাদারদের নাম যদি তদন্তে বেরিয়ে আসে, তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাব।

জাগো নিউজ : না জানতে পারাও তো একধরনের ব্যর্থতা, ক্ষতি তো হচ্ছে…

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : অবশ্যই ক্ষতি হচ্ছে। মুখোশধারীরা রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মিশে থাকেন। সব জানা যায় না। অনেক ঘটনা মৃত্যুর পরে জানা যায়।

জাগো নিউজ : এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : আমরা কোনো ভয় বা শঙ্কা প্রকাশ করি না। কারণ আমরা দেশ এবং মানুষের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। একটি শক্তি যখন ন্যায় এবং সত্যের পথে সংগ্রাম করে, তখন সেই শক্তি পরাজিত হতে পারে না। তবে আমরা সতর্ক আছি।

এএসএস/এমএআর/পিআর