বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুহার কম, ঠিক এই কারণে আত্মতুষ্টি লক্ষণীয় করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ যারা করবেন তাদের মাঝে। সামগ্রিক লকডাউন আর হলোই না, টুকরা টুকরা যে লকডাউন চলছে সেটাও যে খুব ভালোভাবে হচ্ছে তা নয়। গত রোববার লকডাউনে থাকা রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় নমুনা দিয়েছিলেন ১৩ জন, ১২ জনেরই করোনা পজিটিভ এসেছে। বোঝাই গেল কোনো উপকার করেনি এই বিচ্ছিন্ন লকডাউন। শুধু শুধু এলাকার লোকজন একটা বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন।
Advertisement
পূর্ব রাজাবাজার ২১ দিনের লকডাউন শেষে এখনও রেড জোনে। ওয়ারীর অবস্থাতো বোঝাই যাচ্ছে। ওয়ারীর লকডাউন শেষে এই দুটি লকডাউন পরীক্ষায় ঠিক কী কী সন্তোষজনক জবাব পেলেন করোনা ব্যবস্থাপকরা সেটা জাতির সামনে তুলে ধরেবেন আশা করি।
আমরা আমেরিকা, ইতালি, স্পেনের সাথে তুলনা করে বলতে পছন্দ করি যে, উন্নত দেশই পারছে না। যদিও তারা ইতোমধ্যে সংক্রমণ যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন, ব্যাপক করোনার নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে। আমরা উন্নত দেশের দিকে তাকালেও দেখতে চাই না প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা বা ভিয়েতনামের দিকে যারা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে জীবন ও জীবিকা দুটোকেই বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে।
আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে নিউজিল্যান্ডের কথা বলি না। হ্যাঁ নিউজিল্যান্ডের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক কম, তাই হয়তো অনেকে সেই দেশের সাথে আমাদের দেশের তুলনা করতে চাইবেন না। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে যে, নিউজিল্যান্ড প্রথম থেকেই শক্ত লকডাউন চালু রেখেছিল। কিন্তু তারা শুধু লকডাউনই করেনি, বেশি পরিমাণে টেস্টিং, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ও আইসোলেশানের কাজ ঠিকভাবেই করেই সাফল্য পেয়েছে।
Advertisement
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশ কিউবা। কিন্তু এর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা স্বাস্থ্য কাঠামো উন্নত। তারা যা করেছে তা হলো প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ। সরকারি উদ্যোগে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রোগী শনাক্ত করেছে, আইসোলেশান নিশ্চিত করেছে। যাদের হাসপাতাল প্রয়োজন হয়েছে তাদের সরকারি পরিবহনের মাধ্যমে হাসপাতালে আনা হয়েছে।
আমরা যে কী করেছি, সে এক বিরাট ইতিহাস। প্রধানমন্ত্রী মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রণোদনা, নগদ ও খাদ্যসাহায্য যা দিয়েছেন তার একটা ইতিবাচক প্রভাব পেয়েছে মানুষ ও কিছু কিছু খাত। কিন্তু আমরা যে একটা দীর্ঘ সংক্রমণ চক্রে নিপতিত হয়েছি সেটা থেকে বের হওয়ার আলোচনা চাপা পড়েছে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি ভাইরাসের আলোচনায়। বাংলাদেশের করোনাভাইরাস চিকিৎসা ঘিরে বড় বড় দুর্নীতি, ভুয়া করোনা রিপোর্ট, ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট আজ বিশ্বব্যাপী আলোচনায়।
মহামারি ও সংক্রমণ রোধে বড় বড় ভূমিকা রাখে রোগ তথ্য। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করে বাংলাদেশ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে টেস্টিং। সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছিল বাংলাদেশে এবং এখন সেটি আরও কমেছে। দৈনিক আঠার হাজার থেকে টেস্টিং নেমে গেছে এগার-বার হাজারে। সংক্রমণ খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে অর্থনৈতিক সমস্যা আরও তীব্র হবে। মনে রাখতে হবে করোনা কেবল একটি রোগ নয়, একটি বহুমাত্রিক সমস্যা। মানুষ নিয়তই রোগের সাথে লড়াই করে, টিকে থাকে। কিন্তু করোনা রোগ শুধু আমাদের শারীরিকভাবে কাবু করছে না, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে এবং আরও দিচ্ছে।
এ কথা ঠিক যে, আলাদা আলাদাভাবে সুরক্ষিত থাকা প্রতিটা নাগরিকের দায়িত্ব। পরিবার, সহকর্মী, প্রতিবেশী সবার জন্যই এ কথা প্রযোজ্য। কিন্তু এই গরিব দেশের সকলকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগও প্রয়োজন। মাস্ক, ফেসশিল্ড, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ কেনার সাধ্য সবার নেই। নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হলে পরিবারের সবার জন্য এই খরচ আরও কঠিন। এর মধ্যে সরকার আবার সরকারি হাসপাতালে করোনা নমুনা পরীক্ষায় ফি বসিয়েছে। ফলে আরও কমে গেছে টেস্টিং। সরকারি করোনা হাসপাতালে অব্যবস্থাপনায় মানুষ হাসপাতাল ছেড়েছে, এখন করোনার নমুনা পরীক্ষা করাও ছাড়ল।
Advertisement
সংক্রমণ বাড়ছে। টেস্টিং কম হলেও সংক্রমণের হার ২৪ শতাংশের বেশি থাকছে যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এইভাবে আমরা ঠিক কোথায় যে চলেছি, তার উত্তরও পাচ্ছি না। জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্যরা বলছেন তাদের পরামর্শ শোনা হচ্ছে না। ভ্যাকসিন দ্রুত চলে এলে রক্ষা। অন্যথায় আমাদের নিজেদের কঠোরতা ছাড়া উপায় নেই। সামগ্রিকভাবে হটস্পটগুলোকে পুরো লকডাউন করে টেস্টিং, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ও আইসোলেশানের পরিকল্পনা ছাড়া ফলপ্রসূ কিছু হবে না। স্বাস্থ্যখাতের দিকে একটি বিশেষ নজর মানুষ আশা করছে। এমনিতেই মানুষের এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছে, তার ওপর স্বাস্থ্যখাতে বড় বড় দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি ব্যর্থতা নজরে আসছে, মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন সঠিক নম্বরে টেস্টিং, ট্রেসিং, আর আইসোলেশান প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা দরকার। অন্যথায় আমাদের সব প্রণোদনা আর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস