স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সাইফুদ্দিন (৪৮)। কিন্তু রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। ঘরে ফিরেছে তার ছিন্নভিন্ন নিথর দেহ। দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ স্ত্রী পারুল বেগমকে ভাসিয়েছেন অকূল পাথারে।
Advertisement
গত মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) রাতে চাঁপাইনবাবঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভার মর্দানা- আইয়ূব বাজার এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হন সাইফুদ্দিন। বুধবার গ্রামের গোরস্তানে তার মরদেহ দাফন হয়েছে। এখনও শুকায়নি রক্তের দাগ। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নৃশংসতার ছাপ। এখনও থমথমে পুরো এলাকা।
ঠিক যে স্থানে সাইফুদ্দিনের উপর নৃশংসতা চলেছে বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই স্থানে এসে নীরবে চোখের জল ফেলছিলেন স্ত্রী পারুল বেগম।
ঘটনার পর থেকেই ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তবুও উৎকণ্ঠায় পুরো এলাকার মানুষ। এলাকাবাসীর ভাষ্য, পুলিশ না থাকলে সন্তানদের নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই পারতেন না পারুল।
Advertisement
স্বামীর উপর এমন নৃশংসতায় বাকরুদ্ধ পারুল। তিনি বলেন, আমার স্বামী দুপুরে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিলেন। তারপর আর বাড়ি ফেরেননি। আমরা খবর পাচ্ছি, তার উপর হামলা হয়েছে। ফোন দিচ্ছি, সাড়া পাচ্ছি না।
হত্যাকাণ্ডের স্থান দেখিয়ে পারুল বলেন, এখানেই আমার স্বামীকে একদল সন্ত্রাসী কুপিয়েছে। পরে আমাদের বাড়িতে এসে গরু-বাছুরসহ জিনিসপত্র লুটে নিয়ে গেছে। এরপর আর কথা বাড়াতে পারেননি পারুল।
বসতবাড়ি ছাড়া সম্বল বলতে একবিঘা ধানি। বড় ছেলে ইনজামুলকে (২৩) নিয়ে অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন সাইফুদ্দিন। মাঝেমধ্যে অন্যের জমি বর্গাচাষ করতেন। একমাত্র মেয়ে সানজিদা খাতুন (২০) রাণীহাটি ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
ছোট ছেলে পারভেজ (১৮) এসএসসি পাস করে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করেন। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনাসহ সংসার চলতো সাইফুদ্দিনের একার আয়ে। স্বামীকে হারিয়ে কিভাবে বাকি পথ পাড়ি দেবেন সেই দুশ্চিন্তায় পারুল বেগম।
Advertisement
সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন সাইফুদ্দিন। পাশের বাড়ির দরজার ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন তার বড়ভাই মুকুল হোসেন (৫৬)। ভাইয়ের উপর চর্তুমুখী হামলার খবর পেয়ে তিনি ভাইকে রক্ষায় যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিবেশীরা তাকে জোর করে বাড়িতে ঢুকিয়ে নেন।
মুকুল হোসেন বলেন, এর আগে একই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন তার আরেক ভাই তাইফুর রহমান। চোখের সামনে আরেক ভাই সাইফুদ্দিনকে নৃশংসভাবে কোপাতে দেখেছেন। কিন্তু ভাইকে বাঁচাতে পারেননি। প্রতিবেশীরা তাকে আসতেই দেননি।
তিনিও সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে পড়বেন এই শঙ্কায় প্রতিবেশীরাই তাকে আটকে রাখেন। ওই সময় তার বাড়ি, তার আরো ভাই-ভাতিজাদের বাড়িতেও হামলা ও লুটপাট হয়। অবরুদ্ধ থেকে তিনি পুলিশকে আসতে দেখেন। তাও ঘণ্টাখানেক পর। পুলিশ এলে তিনি বেরিয়ে আসেন।
মুকুল হোসেনের দাবি, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের নির্দেশেই এ হামলা হয়েছে। পরে এনিয়ে জেমসহ ৩৪ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি। এর আগেও সাইফুদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে কয়েক দফা হামলা চালায় জেমের অনুসারীরা। কিন্তু বরাবরই প্রাণে বেঁচে যান সাইফুদ্দিন।
সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব চলাকালে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসেন আয়েশা বেগম। ছুটে যান ভাইয়ের কাছে। তার ভাষ্য, ভাইকে রক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার পর তার গলায় ধারালো অস্ত্র ঠেকায় সন্ত্রাসীরা। শুধু নারী হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচেছেন। ওই সময় পরিবারের যে পুরুষ সদস্য আসত, তাকেই হত্যা করত হামলাকারীরা।
অভিযুক্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেম
আয়েশা বেগম জানান, তার ভাইয়ের পুরো শরীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেয় সন্ত্রাসীরা। দুই পা ও দুই হাতের রগ কেটে দেয়। ওই সময় মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তার ভাই। পানি চাইলে সন্ত্রসীরা তার মুখে প্রস্রাব করে।
সন্ত্রাসীরা দূরে সরতেই পাশের টিউবয়েল থেকে পানি আনেন তিনি। পানি মুখে তুলে দেয়ার সময় সন্ত্রাসীরা আবারও ফিরে আসে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে উল্লাস করতে থাকে। আয়েশার অভিযোগ, ঘটনার এক ঘণ্টার বেশি সময় পর পুলিশ এসেছে। আরও আগে পুলিশ এলে ভাইকে হয়ত বাঁচানো যেত।
একেবারেই প্রান্তিক কৃষক ছিলেন সাইফুদ্দিন। তবে কেনো এমন নৃশংসতার শিকার তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসী জানান, গ্রামীণ রাজনীতির বলি সাইফুদ্দিন। সাইফুদ্দিনসহ তার পুরো পরিবার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিরর আবদুস সালামের সমর্থক ছিলেন। আর এ কারণেই বর্তমান কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের রোষানলে পড়ে পরিবারটি।
কেবল এই পরিবারই নয়, যারা কাউন্সিলর জেমের বিরোধিতা করেন তাদেরই সাইফুদ্দিনের মতো পরিণতি বরণ করতে হয়। গত ৫ বছরে এলাকায় অন্তত ৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর প্রতিটিতেই কোনো না কোনোভাবে কাউন্সিলর জেমের হাত রয়েছে। প্রতিপক্ষকে দমাতে বরাবরই নৃশংসতা বেছে নিয়েছেন জেম।
এলাকাবাসী আরো জানান, প্রতিবারই হত্যাকাণ্ডের পর এলাকায় পুলিশ অবস্থান করে। ওই সময় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ সরে যাওয়ার পরই আবারো নিজেদের অবস্থান পাকা করে কাউন্সিলর জেমের বাহিনী। সুযোগ পেলেই এলাকাবাসীর উপর চলে নৃশংসতা। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চান না।
ঘটনার পর থেকে মর্দানা-আইয়ূব বাজার এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন শিবগঞ্জ থানার উপপরির্দক ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসেছে। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও এলাকায় আসছেন। পরিস্থিতি এখন শান্ত। লোকজন নির্ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছেন। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সবধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেমের মোবাইল সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে এ নিয়ে তার মন্তব্য মেলেনি। এলাকাবাসী বলছে এ ঘটনার পর থেকে খাইরুল আলম জেমকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শিবগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৮ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে প্রধান আসামি কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেম পলাতক। তাকেসহ মামলার পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
জানতে চাইলে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর দ্রুত আসামি শনাক্ত করে আইনে সোপর্দ করা পুলিশের প্রথম কাজ। গত কয়েকদিন আগে শিবগঞ্জে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেটি একেবারেই আলাদা। ককটেল ফুটিয়ে পরে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনায় আটজন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিদের বিরুদ্ধেও আইনত ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।
ডিআইজি আরও বলেন, ওই এলাকায় মাস্তানি চলবে না। যারা এই কাজটা করছেন তাদের আমরা আইনের আওতায় আনতে চাই। পাঁচ বছর অনেক সময়। ওই সময়গুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রকৃত দোষিরা বিচারের আওতায় এলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম। অপরাধীদের কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
এফএ/জেআইএম