চলোমান করোনাভাইস (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে দেশের ৮৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্য ও পুষ্টির সঙ্কটে পড়েছেন। পাশাপাশি ৯৮.৩ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনি তথ্য উঠে এসেছে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের জরিপে।
Advertisement
খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ আয়োজিত ‘দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর কোভিড ১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এ ফলাফল প্রকাশ করা হয়। খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের জন্য জরিপটি পরিচালনা করেন বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ।
জরিপের ফলাফল উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, এ জরিপের উদ্দেশ্য ছিল করোনা মহামারির ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের দরিদ্র মানুষের জীবিকা পরিস্থিতি, খাদ্য গ্রহণ ও পুষ্টির অবস্থা বোঝা। পাশাপাশি করোনা ঝুঁকির মধ্যে দরিদ্র মানুষের সচেতনতার পরিস্থিতিও অন্বেষণ করা হয়েছে। দেশের ৮টি বিভাগের ৩৭টি জেলায় দৈবচয়ন পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার ভিত্তিতে অর্থনৈতিকভাবে ঝুকিপূর্ণ ৮৩৪ জন উত্তরদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
নাজনীন আহমেদ বলেন, নগর ও গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীও এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ছিল নারী। উত্তরদাতাদের মধ্যে রিকশা ও ভ্যানচালক, স্কুটার ও ট্যাক্সি ড্রাইভার, পরিবহন শ্রমিক, ছোট দোকানদার, ফেরিওয়ালা, নাপিত, বিউটি পার্লারের কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, খণ্ডকালীন গৃহকর্মী, ইটকল শ্রমিক, ছোট দোকানকর্মী, মালবাহী শ্রমিক, শিপিং ও ই-বাণিজ্য সরবরাহকারী শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক এ রকম নানা পেশার মানুষ ছিলেন। এদের বেশিরভাগই দিন এনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকেন। এছাড়া ভিক্ষুক, পথশিশু, প্রতিবন্ধী যারা প্রকৃত অর্থে বেকার, এমন উত্তরদাতাও ছিলেন।
Advertisement
জরিপ অনুযায়ী, দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালে ৯৮.৩ শতাংশ দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৮৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির সমস্যায় পড়েছেন। দরিদ্র পরিবারগুলোর পাঁচ শতাংশই দিনে মাত্র একবেলা খেয়েছেন।
নাজনীন আহমেদ বলেন, এটি লক্ষণীয় যে, করোনা মহামারি শুরুর আগে উত্তরদাতাদের ৯১.৬ শতাংশ দিনে তিনবেলা এবং বাকিরা দুই বেলা খাবার গ্রহণ করতেন। যদিও বেশিরভাগ উত্তরদাতা সাধারণ সময়ে তিনবেলা খাবার গ্রহণ করতেন, কিন্তু সাধারণ ছুটির সময়ে বিভিন্ন বিভাগের ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ উত্তরদাতা তিনবেলা খাবার গ্রহণে সমস্যার মুখোমুখি হন বলে জানিয়েছেন।
জরিপে দেখা যায়, সব বিভাগেই দরিদ্র লোকেরা পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ভুগছিলেন, যা তাদেরকে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকির সামনে ফেলে দিয়েছে। যদিও মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ এ সময় সাধারণ অসুস্থতায় ভুগেছেন বলে জানিয়েছেন। তুলনামূলকভাবে ময়মনসিংহ ও সিলেটে খাবারের ঘাটতি বেশি ছিল। রংপুর অঞ্চলের দরিদ্ররা খাদ্য সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুষ্টিকর খাদ্য সংকটে বেশি প্রভাব পড়েছে রাজশাহী অঞ্চলে। অর্ধেক দরিদ্র মানুষ সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে কিছু খাদ্য ও অর্থ সহায়তা পেয়েছিলেন। প্রায় ৭ শতাংশ মানুষ তাদের পেশা পরিবর্তন করেছেন। তুলনামূলকভাবে সহজ বলে এদের বেশিরভাগই দিনমজুর ও কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। তবে বোরো ধান কাটার মৌসুম ছিল বলে কৃষি শ্রমিকরা সাধারণ ছুটি চলাকালীন কাজ পেয়েছেন। করোনাভাইরাসের সাথে সম্পর্কিত জীবিকার সঙ্গে জড়িত দরিদ্র মানুষের আয়ের ক্ষতি হয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সরকার মার্চের শেষের দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে এবং তা দুই মাসেরও বেশি সময় অব্যাহত থাকে। যদিও মে মাসের গোড়ার দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত আকারে চালু হয়, কিন্তু অর্থনৈতিক কার্যক্রম সার্বিক অর্থে এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এতে দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি হচ্ছে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তাদের কারো আয় হ্রাস পেয়েছে, কেউ চাকরি হারিয়েছেন, দোকানপাট এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বন্ধসহ আয়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার মুখোমুখিও হয়েছেন অনেকে।
Advertisement
আয় না থাকায় দরিদ্র মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টির সংকটে পড়েছে। বিশেষত শিশু, গর্ভবতী নারীদের পুষ্টির অবস্থা এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দরিদ্র মানুষের কাছে কার্যকর সহায়তা পৌঁছে দিতে হলে একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি এখন সময়ের চাহিদা।
খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে এবং খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সঞ্চালনায় এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম। এতে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এস এম জুলফিকার আলী ও আইসিসিও কোঅপারেশন বাংলাদেশের কর্মসূচি প্রধান মো. আবুল কালাম আজাদ।
এমইউএইচ/এমএসএইচ/জেআইএম