করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগে স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা অপকর্মের দায়ে গ্রেফতার রিজেন্ট গ্রুপ ও হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদকে আজ আদালতে হাজির করা হয়েছে। আদালতের কাঠগড়ায় ঢুকেই পান করার জন্য বারবার পানি চেয়েছিলেন তিনি। পানি দেয়ার পর ফের পানি চান। পানি দেয়া নিয়ে পুলিশ ও সাহেদের আইনজীবীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হয়।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) সকালে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিমের আদালতে সাহেদ-মাসুদ ও তারিকুলকে হাজির করে পুলিশ। এ সময় তাদের রাখা হয় আদালতের কাঠগড়ায়। আসামিদের চেনার সুবিধার্থে পুলিশ সদস্যরা তাদের মাথার হেলমেট খুলে দেন।
এ সময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে সাহেদ বলেন, ‘আমার হাতের হ্যান্ডকাপ খুলে দেন’। এরপর একজন পুলিশ সদস্য তার তাদের হ্যান্ডকাপ খুলে দেন। সাহেদ পানি খেতে চান। এর মধ্যে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এ সময় তিনি আবারও পানি খেতে চান। তখন আদালতের এক স্টাফ তাকে একটি পানির বোতলে করে পানি দেন। সে অনেকটা পানি পান করে বোতল আবার আদালতের স্টাফকে নিয়ে দেন।
একটু পর তিনি আবার পানি পান করতে চান। এর মধ্যে রিমান্ড শুনানি শেষে সাহেদ-মাসুদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আর তাদের সহযোগী তারিকুলের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
Advertisement
আদালতে রিমান্ড শুনানি চলাকালে কাঠগড়া থেকে বিচারকের উদ্দেশে সাহেদ বলেন, ‘আমি কি একটা কথা বলতে পারি?’ এটি বলেই কাঠগড়ার ভেতরে কান্নাকাটি শুরু করেন সাহেদ।
এরপর তাদের কাঠগড়া থেকে বের করা হয়। এ সময় সাহেদ আবারও পানি চান। তখন এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘এত ঘন ঘন পানি চাইলে কীভাবে হবে? একটু আগে তো আপনি পানি খেলেন। রিমান্ডের আসামিকে এভাবে পানি দেয়া ঠিক না। তদন্তকারী কর্মকর্তা আছেন তাকে বলেন।’
এ সময় সাহেদের আইনজীবীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে যান। তারা বলেন, ‘একজন মানুষ পানি খেতে চাচ্ছে, আপনারা তাকে পানি দিচ্ছেন না’।
জবাবে পুলিশ সদস্যরা বলেন, ‘আমরা তো তাকে পানি দিয়েছি।’ এ নিয়ে পুলিশ আইনজীবীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। এরপর সাহেদসহ অপর দুই আসামিকে হেলমেট ও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আদালত থেকে বের করে নিয়ে যায় পুলিশ।
Advertisement
এর আগে আজ সকালে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
করোনায় সাহেদের কাণ্ড-
করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল। ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত হাসপাতালে ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ১০ হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছিল রিজেন্ট। বিনিময়ে তারা জনপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ৪ হাজার নিতেন। আর বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করলে এক হাজার টাকা বেশি নেয়া হতো। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২০০টির মতো নমুনা পরীক্ষা করে হাসপাতালটি। পরীক্ষা না করেই বাকি ৬ হাজারের মতো নমুনার রিপোর্টই মনগড়াভাবে তৈরি করে দেয় সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতাল।
করোনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবেও অনুমোদন পেয়েছিল সাহেদের রিজেন্ট। এতে করোনা রোগীদের কাছ থেকে কোনো ফি নেয়ার কথা ছিল না। তবে র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে, রিজেন্টে রোগী প্রতি দেড়লাখ, দুইলাখ ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা বিল আদায় করা হয়েছিল। পাশাপাশি ‘রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে’ এই বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বিল জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। যদিও এই অর্থ প্রক্রিয়াধীন থাকলেও শেষ পর্যন্ত পায়নি হাসপাতালটি।
এছাড়া হাসপাতালটিতে করোনা টেস্টের অননুমোদিত কিটও পায় র্যাব। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার যে কিট ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি, সেটি দিয়েও টেস্ট করে রিজেন্ট। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্টে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের কোনো টাকা নেয়ার কথা না। তবে টেস্টে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে নিত তারা। যাদের ‘করোনা পজিটিভ’ রিপোর্ট দেয়া হতো, তাদের কাছ থেকে ফের পরীক্ষার জন্য আরও এক হাজার টাকা নেয়া হতো।
সাহেদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ-
অভিযোগ থাকায় গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরার শাখায় অভিযান পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। সেখানেই সাহেদের পাপ সাম্রাজ্যের প্রথম দ্বার উন্মুক্ত হয়। এরপর থেকেই পলাতক সাহেদ। সাহেদকে পলাতক দেখিয়ে ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। সিলগালা করা হয় উত্তরার রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়সহ মিরপুরের শাখাটিও। ফ্রিজ করে রাখা হয় সাহেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব। রিমান্ডে নেয়া হয় তার অপকর্মের সহযোগীদের।
কোথায় পালিয়ে ছিলেন সাহেদ-
র্যাব ডিজির ভাষ্যমতে, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একেকদিন একেক জায়গায় আত্মগোপনে ছিল। ঢাকা, কক্সবাজার, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুকৌশলে আত্মগোপনে ছিল সে। দেবহাটার কোমরপুর সীমান্তে লবঙ্গবাতি খাল দিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করলে সে ধরা পড়ে।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন সাহেদ-
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শাখরা কোমরপুর বেইলি ব্রিজের পাশে নর্দমার মধ্যে থেকে বোরকা পরা অবস্থায় সাহেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে একটি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গ্রেফতার এড়াতে গত কয়েকদিন ধরেই সাহেদ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। অর্থাৎ একদিন এ জায়গায় তো পরেরদিন অন্য জায়গায়। র্যাব তাকে ফলো করে। গ্রেফতার বিষয়ে র্যাব মহাপরিচালক জানান, ‘সে ঢাকা ছেড়েছে আবার ঢাকায় ফিরেছে, আবার বেরিয়েছে। এসবের মধ্যেই ছিল। এই পুরো সময়টাতে সে কখনও ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনও হেঁটে, কখনও ট্রাকে চলাচল করেছিল। অবশেষে নৌকা দিয়ে পার হওয়ার সময় আমরা তাকে ধরতে সক্ষম হয়েছি’।
সাহেদের গ্রেফতারের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল ইসলাম জানান, ফজরের নামাজের জন্য তিনি মসজিদে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই তাদের কানে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। শুরু হয় হইচই। ঘটনা কী দেখার জন্য দৌড়ে যান সবাই। গিয়ে যা দেখলেন, সারা দেশের আলোচিত প্রতারক সাহেদ করিমকে ধরে ফেলেছে র্যাব।
সাহেদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার পরবর্তী পদক্ষেপ-
র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর সাহেদকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়। সাহেদকে বহনকারী হেলিকপ্টার বুধবার (১৫ জুলাই) সকাল ৯টার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে। এরপর বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে তাকে ঢামেকে নেয়া হয়। সেখানে তার এক্স-রে ও ইসিজি করা হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে সাহেদকে ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে তাকে আদালতে উঠানো হয় সেখানে তার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক।
জেএ/এফআর/এমকেএইচ