অর্থনীতি

বিশ্ববাজারে বাড়ছে চায়ের দাম, দেশে ক্রেতা নেই

অস্বাভাবিক দরপতনের পর বিশ্ববাজারে চায়ের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এক সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। আর মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও দেশের বাজারে কমেছে চায়ের ক্রেতা। বিক্রি না হওয়ায় নষ্ট হচ্ছে চায়ের পাতা।

Advertisement

দেশের চা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে চায়ের বড় ক্রেতা টং দোকান এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ। মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মার্চের ২৬ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সব বন্ধ ছিল। এখন দোকান খুললেও বিক্রি আগের মতো নেই। মানুষ দোকানে এসে চা কম খাচ্ছে। ফলে আশঙ্কাজনক হারে চা বিক্রি কমে গেছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের দাম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চায়ের দামে মহামারি করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক বাজারেও পড়েছে। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার আগে গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের কেজি ছিল ৩ দশমিক ৪১ ডলার।

ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীনে করোনার প্রকোপ শুরু হলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দাম কমে ২ দশমিক ৫০ ডলারে নেমে আসে। করোনার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দামে দরপতনও চলতে থাকে। মার্চের শুরুতে দাম আরও কমে ২ দশমিক ২৫ ডলারে নামে।

Advertisement

এরপর কিছুটা দাম বেড়ে মার্চের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের কেজি ৩ দশমিক ২৫ ডলারে ওঠে। তবে এপ্রিলে আবার দাম কমে যায়। দফায় দফায় দাম কমে জুনে ১ দশমিক ৯০ ডলারে নেমে যায়।

বড় ধরনের এই দরপতনের পর চলতি মাস থেকে আবার চায়ের দাম বাড়তে শুরু করেছে। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) লেনদেন শেষে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি চায়ের দাম দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫৪ ডলার।

এতে সপ্তাহের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর মাসের ব্যবধানে ৩৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং বছরের ব্যবধানে ২০ দশমিক ৯৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা বছরে ৯ কোটি কেজি। ২০১০ সাল থেকে এ চাহিদা পূরণ করতে চা আমদানি শুরু হয়। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ এক কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়। ২০১৬ সালে আট কোটি ৫০ লাখ কেজি রেকর্ড উৎপাদন করে চায়ের চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশ।

Advertisement

গত বছর (২০১৯ সাল) চা শিল্প ১৬৫ বছরের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ে। বছরটিতে রেকর্ড ৯ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। তার আগের বছর ২০১৮ সালে দেশে ৮ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে চায়ের উৎপাদন ১৪০ মিলিয়ন বা ১৪ কোটি কেজিতে উন্নীত করতে কাজ করছে চা বোর্ড।

চায়ের উৎপাদন ভালো হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে চা রফতানি করে কিছু আয়ও হচ্ছে। চা রফতানি করে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৭ লাখ ১০ হাজার ডলার, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৮ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় হয়েছে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের সময় দেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। তখন তিন কোটি কেজির মতো চা উৎপাদন হত।

বর্তমানে সারাদেশে বিদেশি কোম্পানি, সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ছোট-বড় মিলিয়ে চা বাগানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৬টি। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯২টি চা বাগান। বাকিগুলোর মধ্যে হবিগঞ্জে ২৪টি, সিলেটে ১৯টি, চট্টগ্রামে ২২টি, পঞ্চগড়ে সাতটি, রাঙ্গামাটিতে দুটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি। এসব বাগানে মোট জমির পরিমাণ দুই লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৯ একর।

এদিকে গত বছর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদনের পরও চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কম ধরা হয়েছে। গত বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ মিলিয়ন বা ৮ কোটি কেজি। চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি।

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত) উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ ৪৬ হাজার কেজি। গত বছর প্রথম পাঁচ মাসে উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৬২ লাখ ৮১ হাজার কেজি।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের বিপণন কর্মকর্তা আহসান হাবিব জানান, গত মৌসুমে (এপ্রিল ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২০) চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলের ৪৫টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৯০.৪৪ মিলিয়ন কেজি। যার গড় দাম ছিল ১৭৬.০৮ টাকা। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছয়টি এবং শ্রীমঙ্গলে তিনটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিক্রি হয়েছে ৬.৬৬ মিলিয়ন কেজি। গত বছরের চেয়ে এ বছর চায়ের দামও কমেছে।

এইচআরসি সিন্ডিকেট লিমিটেডের মালিক মোহাম্মদ ইদ্রিস জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ধারণা এ বছর চা উৎপাদন গত বছরের চেয়ে অনেক কম হবে। উৎপাদন কম হলেও এখন আমাদের বিক্রি নেই। অনেক চা নষ্ট হচ্ছে। বছরের শেষের দিকে বাজারে এর একটা প্রভাব পড়তে পারে। তখন দাম বাড়বে।

আন্তর্জাতিক বাজারে দামের প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে কিনা জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দামের প্রভাব আমাদের এখানে পড়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। কারণ আমাদের চা স্থানীয় বাজার নির্ভর। আমদানি বা রফতানির পরিমাণ খুবই সীমিত। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে রফতানি একেবারেই নেই।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করার পরিকল্পনা ছিল। সে লক্ষ্যে আমরা সফল ছিলাম। গত তিন বছরে আমদানি নির্ভর চা রফতানিমুখী হয়েছে। চা শিল্প তিন বছরে যে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল তা সামনে অনিশ্চিত । কারণ আমরা কেউই জানি না করোনা কতদিন থাকবে।

নাহার চা বাগানের জেনারেল ম্যানেজার পিযুষ কান্তি বলেন, ওয়্যারহাউসগুলোতে (চা রাখার স্থান) চা জমছে, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না। আমাদের ওয়্যারহাউসে জমা আছে প্রায় ৩০ হাজার কেজি চা। আমরা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি। চা বিক্রি হচ্ছে না, আবার শ্রমিকদের বেতন বাকি রাখা যাচ্ছে না। তার ওপর চায়ের দাম স্মরণ কালের মধ্যে সবচেয়ে কম। বর্তমানে ১৫৫ টাকা গড় দামে চা বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলি জানান, করোনার কারণে চা বিক্রি তিনগুণের বেশি কমেছে। ভালো কোয়ালিটির চা বিক্রি হলেও সাধারণ মানের চা যা সাধারণ চায়ের দোকান বা রেস্তোরাঁয় বিক্রি হয় তা কমেছে। নিলামে যে চা উঠছে তার প্রায় অর্ধেক অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। ফলে ওয়্যারহাউসগুলোতে চা জমছে। এভাবে আরও কয়েক মাস গেলে চা রাখার জায়গার যেমন অভাব হবে তেমনি নষ্ট হবে চায়ের কোয়ালিটি। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় চায়ের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় কম হচ্ছে।

হামিদিয়া চা বাগানের ম্যানেজার মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, চা বিক্রি হচ্ছে না, দামও কমেছে। ওয়্যারহাউসে চা জমে আছে। এতে নষ্ট হতে পারে চা এবং চায়ের মান। গত বছর আমরা এক লাখ ৮৫ হাজার কেজি চা উৎপাদন করেছি। যার দাম ছিল কেজিপ্রতি গড়ে ১৭৬ টাকা। এ বছর গত বছরের চেয়ে চা উৎপাদন কিছুটা কমেছে, সঙ্গে দামও কমেছে। এ বছর গড়ে ১৫৫ টাকা করে চা বিক্রি হচ্ছে। তার চেয়ে বড় বিষয় ৬০ শতাংশ চা অবিক্রীত থাকছে। আমার বাগানের ওয়্যারহাউসে প্রায় ২৫ হাজার কেজি চা জমে আছে, বিক্রি হচ্ছে না। চরম সংকটে আমরা। বাগান বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনাও পাইনি। ব্যাংকও আমাদের লোন দিচ্ছে না।

টি প্লান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিপিটিএবি) সদস্য সচিব জহর তরফদার বলেন, এ বছর আমাদের শ্রীমঙ্গলের নিলাম কেদ্রে ২০টি নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এখন পর্যন্ত তিনটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নিলামে ১৮ হাজার ৭০০ কেজি চা বিক্রি হয়েছে। ক্রেতাদের অংশগ্রহণ কমেছে, সঙ্গে চায়ের দামও কমেছে।

এমএএস/এমএফ/জেআইএম