বিশেষ প্রতিবেদন

‘খামখেয়ালিতে’ নিষেধাজ্ঞা, ইমেজ রক্ষায় কঠোর সরকার

চলতি বছরের মার্চে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতালিতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ শতাধিক রোগীর মৃত্যু হচ্ছিল তখন বলা হয়েছিল, ইতালি থেকে বাংলাদেশে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। মার্চের মাঝামাঝি ইতালিসহ ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে ফ্লাইট আসা স্থগিত করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এখন সেই ইতালি বাংলাদেশিদের তাদের দেশে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

Advertisement

শুধু ইতালি নয়, জাপানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, চীনের সাময়িক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে দুই এয়ারলাইন্স। এছাড়া প্রত্যাহারের পর দ্বিতীয়বার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তুরস্ক এবং বাংলাদেশিদের জন্য কড়া বিধিবিধান প্রস্তুত করে দিয়েছে সংযুক্ত আরব-আমিরাত

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিমানের সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া ফ্লাইট স্থগিত রেখেছে।

বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এমনিতেই আকাশপথে যাত্রীর সংকট, এর মধ্যে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপে বিপর্যয়ের মুখে বিমান। ইতালিতে বাংলাদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়ে দেশটির সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেছে বেবিচক। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এত বড় কঠোর সিদ্ধান্তের কারণও জানতে চাওয়া হয়।

Advertisement

ভিডিও কনফারেন্সে ইতালির সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে, দেশটি স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অবজারভেশন অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা সে দেশে গিয়ে ঠিকমতো কোয়ারেন্টাইন মানছেন না। তারা বাইরে চলাফেরা করছেন। তাদের কোনোমতেই কোয়ারেন্টাইনে বাধ্য করা যাচ্ছে না। দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে, বাংলাদেশি প্রবাসীরা ইতালির ক্ষতি করছেন। এ কারণেই নিষেধাজ্ঞা। বাংলাদেশি প্রবাসীদের এমন কর্মকাণ্ডে বিব্রত সরকারও। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেবিচক বিদেশগামীদের জন্য আরও কঠোর বিধিনিষেধ ও নিয়মকানুন আরোপ করতে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ গমনকারীদের জন্য ‘করোনা নেগেটিভ’ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নেয়া হচ্ছে আরও পদক্ষেপ।

বেবিচক বলছে, যাত্রীদের খামখেয়ালিপনার কারণে এ ধরনের কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো। যাত্রীদের জন্য বেবিচক আরও কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্রিনিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মেডিকেল অফিসার চাওয়া হয়েছে। এত দিন এ দায়িত্বপালন করতেন বেবিচকের সিকিউরিটি অফিসাররা।

একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, এসব ঘটনায় অবশ্যই আমাদের দেশের ল্যাকিংস আছে। তা না হলে তারা কীভাবে বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে যাচ্ছে? দেশে জাল করোনা রিপোর্ট দেয়াসহ যেসব ঘটনা ঘটেছে, বিশ্বের দেশগুলো তা গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে। ফলে বাংলাদেশিদের ওপর বিভিন্ন দেশের অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। করোনায় এমনিতে উন্নত দেশগুলো সংকটের মধ্যে আছে, এর মধ্যে বাংলাদেশিদের ঢুকতে দিয়ে কেউ আর সংকট বাড়াতে চাইছে না।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা এখনও তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি। তবে সরকারের উচিত করোনা সার্টিফিকেটগুলো কাগজে বা হার্ডকপিতে না রেখে সম্পূর্ণ অনলাইনে করে দেয়া। কারণ কাগজে রিপোর্ট দিলে তা ঘষামাজার সুযোগ থাকে। অনলাইনে এমনভাবে রিপোর্ট দিতে হবে, যাতে এনআইডি নম্বর দিলেই রিপোর্ট চলে আসে। এতে একজন প্রবাসী যে দেশেই যাবে সে দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশও সহজে তার রিপোর্টটি দেখে নিতে পারবে। এভাবে করলে জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব। যদি এখন থেকেই উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা সুখকর হবে না।

একের পর এক দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসার বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাওয়া হয় বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের কাছে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্ক্রিনিং, হেলথ কার্ড পূরণসহ বাংলাদেশ থেকে যে প্রক্রিয়ায় বিমানযাত্রীরা বিদেশে যাচ্ছেন, এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন (আইকাও) স্বীকৃত। এই প্রক্রিয়া ঠিকই আছে। তবে বিদেশে গিয়ে ঠিকমতো কোয়ারেন্টাইনে না থাকলে আমাদের কিছু করার থাকে না। এছাড়া সব যাত্রী বাধ্যতামূলক টেস্ট করে গেলে সে দেশে গিয়ে আক্রান্তের সংখ্যাটা কমে যাবে, দেশের ভাবমূর্তিরও উন্নতি হবে।’

তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিনে মিডিয়ায় যেভাবে এককভাবে বাংলাদেশি প্রবাসীদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, তা দুঃখজনক। আমাদের জানা দরকার, ইতালি কেবল বাংলাদেশের নাগরিকদের নয়, বরং তারা ১৩টি দেশের নাগরিকদের সে দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’

‘এছাড়া বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। যেসব দেশে এ হার ঊর্ধ্বমুখী তাদের ইতালিতে প্রবেশ করতেই দেয়া হচ্ছে না। আমরা বিমানবন্দরের বহির্গমন গেটে স্ক্রিনিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চেয়েছি। স্বাস্থ্য অধিদফতর ২-৩ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দেবে বলে আমাদের আশ্বাস দিয়েছে। তারা আসলে স্ক্রিনিং আরও ভালোভাবে করা হবে।’

ইতালির নিষেধাজ্ঞা

গত ৬ জুলাই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ থেকে ইতালি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটির সরকার।

একই সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া ৫০০-৬০০ বাংলাদেশিকে খুঁজে বের করে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইতালির স্বাস্থ্য বিভাগ।

জাপানে নিষিদ্ধ বিমান বাংলাদেশ

কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর গত ২৯ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান জাপান ও ঢাকার মধ্যে চারটি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে। এসব ফ্লাইটের যাত্রীদের করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকলেও দেশটির বিমানবন্দরে কয়েকজন যাত্রীর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। এর পরপরই জাপানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটির সরকার।

চীনের সাময়িক নিষেধাজ্ঞায় দুই এয়ারলাইন্স

ঢাকা থেকে গুয়াংজুগামী একটি ফ্লাইটে ১৭ যাত্রীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় ওই রুটে ২২ জুন থেকে চায়না সাউদান এয়ারলাইন্সের সব ফ্লাইট চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে চীন সরকার। একই রুটে পরিচালিত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে পাঁচ যাত্রীর করোনাভাইরাস ‘পজিটিভ’ এলে ৬ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে ফ্লাইট পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যদিও এই সাতদিনে মাত্র একটি ফ্লাইট ছিল ইউএস-বাংলার।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে কড়া বিধিবিধান আরোপ

বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের হার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বাংলাদেশি যাত্রীদের দুবাই ও আবুধাবিতে প্রবেশের পূর্বশর্ত হিসেবে যাত্রার ৯৬ ঘণ্টা আগে পরীক্ষা করে করোনা ‘নেগেটিভ’ সার্টিফিকেট নিতে বলেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সরকার। এছাড়া দেশটির সরকার করোনা টেস্টের জন্য ২৯টি ল্যাব নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এর মধ্যে ২৪টি ল্যাব সরকারি এবং বাকি ছয়টি বেসরকারি ও স্বনামধন্য প্রাইভেট হাসপাতালের।

প্রত্যাহারের পর দ্বিতীয়বার নিষেধাজ্ঞা তুরস্কের

প্রায় সাড়ে তিন মাস পর গত ৩ জুলাই থেকে ইস্তাম্বুল-ঢাকা রুটে ফ্লাইট চালুর কথা ছিল টার্কিশ এয়ারলাইন্সের। হঠাৎ করে বাংলাদেশসহ বেশকিছু দেশের সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তুরস্ক।

এআর/এমএআর/এমএস