জাতীয়

করোনায় কর্ম হারিয়ে লজ্জা বিসর্জন

জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিপরীত রাস্তার ফুটপাতে বসে পথচারীদের কাছে সাহায্য চাচ্ছেন এক ভিক্ষুক। সাহায্য চাওয়ার ধরন কিছুটা ভিন্ন, যা শুনেই বোঝা যায়, তিনি পেশাদার কোনো ভিক্ষুক নন বা ভিক্ষা তার পেশা নয়।

Advertisement

এমন কৌতূহল নিয়ে কথা বললে জানান, তার নাম মোহাম্মদ শাহেদ। তিনি কেরানীগঞ্জে রিকশা চালাতেন। সারাদিনে যে আয় হতো তার বড় একটা অংশ রিকশা মালিককে দিতে হতো। বাকি টাকা দিয়ে কোনো মতে সংসার চলতো। সংসার বলতে তার স্ত্রী, এক ছেলে এবং মেয়ে। গত ফেব্রুয়ারিতে স্ত্রী মারা যায়। এরপর করোনার ধাক্কায় সব কিছুই লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

করোনার কারণে কাজ হারিয়ে এখন কঠিন সঙ্কটে তার জীবন-জীবিকা। কর্ম হারিয়ে ক্ষুধা আর সংসারের ঘানি টানতে লজ্জা বিসর্জন দিয়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। এ পেশার কথা তার আপনজনরা কেউ জানেন না।

শাহেদ বলেন, করোনার সময় রিকশার জমার টাকাই উঠছিল না। যাত্রী নেই, ইনকামও নেই। এ কারণে ঠিকমতো জমার টাকাও দিতে পারতাম না। কিন্তু পেট তো আর মানে না। তাই বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসেছি অন্য কাজের জন্য। কিন্তু এখানেও একই দশা। নতুন করে কেউ কাজে নেয় না। ফলে বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করছি। বদলে গেল আমার পেশা। রিকশাচালক থেকে হয়ে গেলাম ভিক্ষুক। এখন রাস্তায় ভিক্ষা করি। করোনায় কর্ম হারিয়ে লজ্জাকে বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি শুধু পেটের জন্য, সংসারের জন্য।

Advertisement

মোহাম্মদ শাহেদই নন, করোনায় তার মতো অনেকেই অর্থ উপার্জনের ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন, যা গোপন রাখছেন পরিবার-আপনজনদের কাছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে চাকরি করতেন নাজমুল হক (ছদ্ম নাম)। করোনার ধাক্কায় চাকরি হারিয়েছেন। একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন। চাকরি হারিয়ে প্রথমে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি জামালপুর যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাবেন বাড়ি গিয়ে কী করবেন? তাই জীবিকার তাগিদে লজ্জা বিসর্জন দিয়ে ফুটপাতে অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়েছেন।

নাম, ছবি, পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, করোনায় চাকরি চলে যায়। সংসার কীভাবে চলবে? খাবো কী? না এই পরিস্থিতিতে গ্রামে চলে যাবো...। এমন সব বিষয় মাথায় ঘুরপাক খায়।

এদিকে বাসা ভাড়াও বাকি। এ অবস্থায় গ্রামের বাড়ি থেকে কিছু টাকা আনি এবং বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করে কিছু টাকা দিয়ে মোবাইল এক্সেসরিজ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস, মাস্ক অর্থাৎ করোনা থেকে প্রোটেকশন পাওয়ার পণ্য কিনে তা ফুটপাতে বিক্রি করছি। পরিচিত কেউ যেন আমাকে দেখে না ফেলে, সে কারণে মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে রাখি। কেউ দেখে ফেললে তো লজ্জায় পড়তে হবে। ভালো বেতনে চাকরি করতাম কিন্তু আজ আমি ফুটপাতের হকার। করোনায় চাকরি হারিয়ে লজ্জা বিসর্জন দিয়েছি। ভিন্ন কর্ম বেছে নিয়েছি। পরিবার স্বজন সবার কাছে নিজের এই দুর্বলতার কথা গোপন রেখেছি। এ অবস্থায় এসব বিক্রি করে কোনো মতে টিকে আছি। তবে প্রতি মাসে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে চাপ হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহই জানেন এ বিপদের মধ্যে কত দিন চলতে হবে।

Advertisement

এদিকে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দুই হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোকের চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। দৈনিক মজুরিভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০ জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ।

বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের ‘স্বপ্ন গড়ার শহর’ ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এই শহরে মানুষ বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। কিন্তু গত মার্চে করোনা হানা দেয়ার পর মানুষের স্বপ্ন যেন ভাঙতে শুরু করে। গত কয়েক মাসে আয়-রোজগার কমে এমনকি কর্ম হারিয়ে বিপাকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। হতদরিদ্ররা হয়ে পড়েছেন আরও অসহায়। জীবিকার এমন সংকট দেখা দেয়ায় ঢাকা ছাড়ছেন অনেকেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে রাজধানীতে লোকসংখ্যা ছিল ৬৮ লাখের সামান্য কিছু বেশি। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত রাজধানীর লোকসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাসের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাসিন্দা এক কোটি ৭০ লাখ।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০০৭ সালের পর খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা কারণে দেশে উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। যাদের অধিকাংশই কর্মের সন্ধানে ঢাকায় আসে। করোনার ধাক্কায় এসব মানুষের জীবনে এখন বড় বিপর্যয় নেমেছে। বাধ্য হয়েই দুঃখ আর অসহায়ত্বকে সঙ্গী করে ছাড়তে হচ্ছে স্বপ্ন গড়ার শহর ঢাকা।

এএস/এএইচ/পিআর