বিশেষ প্রতিবেদন

৬৪ জেলায় ৬৪ সচিব : যেমন চলছে করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রম

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চলমান ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে গত এপ্রিলে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয় সরকার। দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা সংশ্লিষ্ট জেলায় সরেজমিনে গিয়ে এবং ভার্চুয়ালি সমন্বয়ের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সচিবরা সমন্বয়ের কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।

Advertisement

সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা সচিবরা বলেছেন, কোথাও সংক্রমণের হার বাড়ছে, কোথাও কমছে। তারা আরও বলছেন, বিভিন্ন জেলায় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। যতটুকু আছে তা দিয়েই তারা সমন্বয়ের মাধ্যমে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছেন। সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা দফতরে চিঠি দিচ্ছেন।

এছাড়া জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও সচিবদের সমন্বয় কার্যক্রম ও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের।

গত ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৬৪ সচিবকে ৬৪ জেলার দায়িত্ব দিয়ে আদেশ জারি করা হয়। কিছু সচিব বদলি ও অবসরে যাওয়ার কারণে পরে ১৫ জুন আরেকটি আদেশ জারি করা হয়।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জেলার সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার কাজ তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ করবেন।

এতে আরও বলা হয়, সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমস্যা/চ্যালেঞ্জ অথবা অন্যবিধ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দফতর/সংস্থাকে লিখিতভাবে জানাবেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে নিয়মিত অবহিত করবেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাতক্ষীরায় যে ডাক্তাররা করোনার চিকিৎসা দিচ্ছেন তাদের সঙ্গে মিটিং করেছি। হাসপাতাল পরিদর্শন করেছি। জেলা প্রশাসক অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেছি। ওখানে (সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা থাকলেও ভেন্টিলেটরে ক্যানোলা নেই। ভেন্টিলেটরও রয়েছে চারটি। ক্যানোলা থাকলে অন্তত চারটি লোককে হাইফ্লো অক্সিজেন দেয়া যেত। অক্সিজেন না পেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’

তিনি বলেন, ‘ওখানে পিসিআর মেশিন নেই, লোকবলের অভাবও রয়েছে। ৫০ জন নার্সের পদ শূন্য। টেকনিশিয়ান নেই, ডাক্তারও কম। চারটি ভেন্টিলেটর নষ্ট হয়ে রয়েছে, এই চারটি মেরামত করলে অন্তত আটজনকে ভেন্টিলেটর দেয়া যেত।’

Advertisement

 

‘সরকারের বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে আমি নিজ উদ্যোগে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকার চারটি ক্যানোলা সংগ্রহ করে দিয়েছি।’

দায়িত্ব পাওয়ার পর সাতক্ষীরায় তিনবার গিয়েছেন জানিয়ে ইউসুফ হারুন বলেন, ‘সরাসরি যাওয়ার পাশাপাশি জুমের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে সাতক্ষীরার সকল ইউএনও, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মিটিং চালিয়ে যাচ্ছি। আমি যাওয়ার আগে সাতক্ষীরার চারজন এমপির সঙ্গে আলাপ করে গিয়েছি। সাতক্ষীরায় সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘ওখানে মাস্কের সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি তারা যেন দ্রুত সেটা দিয়ে দেন।’

সম্প্রতিক সময়ে সাতক্ষীরায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন জনপ্রশাসন সচিব।

জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির (এনএপিডি) মহাপরিচালক (সচিব) মোহাম্মদ আবুল কাসেম পেয়েছেন রাজশাহী জেলার দায়িত্ব। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মে মাস পর্যন্ত রাজশাহীর অবস্থা ভালো ছিল। এখন শহরের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গতকাল পর্যন্ত রাজশাহী শহরে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৬০১ জন। শহরের বাইরে তেমন আক্রান্ত নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কোরবানির পশুর হাটকে ভিড়মুক্ত ও নিরাপদ করতে চাই। গরুর হাটে অযথা ঘোরাঘুরি করার কোনো সুযোগ থাকবে না। স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি যেন মানা হয় তা নিশ্চিত করা হবে।’

‘আমরা রাজশাহীতে কোনো এলাকা লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। কারণ ওই এলাকা মেইনটেইন করা খুব কঠিন। তাই আমরা বলেছি, কোনো বাড়িতে করোনা রোগী পাওয়া গেলে সেই বাড়িসহ আশেপাশের কয়েকটি বাড়ি লকডাউন করতে। এলাকাভিত্তিক লকডাউনে আমরা যাবো না। সন্ধ্যা ৭টার পর যেন মানুষ বাড়ির বাইরে না বের হয় আমরা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেখানে সপ্তাহে তিন দিন হাট বসে সেখানে সপ্তাহে দু’দিন বসানো যায় কি-না, তা আমরা বিবেচনা করছি। সংক্রমণ কমিয়ে আনতে আমরা সবাই একমত হয়ে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

এনপিডি মহাপরিচালক বলেন, ‘ঈদের সময় অন্য জায়গা থেকে এলে তাকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে বলে আমরা প্রচারণা চালাব। এরপরও যদি কেউ আসে তাহলে আসবে।’

আমি রাজশাহীতে তিনবার গিয়ে মিটিং করেছি। এছাড়া জুমের মাধ্যমে অনেক মিটিং করেছি—বলেন আবুল কাসেম।

ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. ইয়াকুব আলী পাটোয়ারী রয়েছেন নওগাঁ জেলা সমন্বয়ের দায়িত্বে। তিনি বলেন, ‘নওগাঁতে করোনা পরীক্ষার কোনো আরটি-পিসিআর ল্যাব নেই। ঢাকা থেকে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। আগে রিপোর্ট পেতে ১৫ দিনও লাগত। আমাদের উদ্যোগের কারণে তিন দিনে পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ওখানে আরটি-পিসিআর ল্যাব করা দরকার, অক্সিজেন প্ল্যান্ট করা দরকার। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। একেবারে পুরোটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাতে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। আমি ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ডিও লেটার দিয়েছি। তারা পার্ট বাই পার্ট এটা করতে পারত।’

নওগাঁয় সংক্রমণের হার খুব কম এবং পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো বলেও জানান তিনি।

ইয়াকুব আলী পাটোয়ারী বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই ওখানে যারা আছেন তাদের সঙ্গে কথা বলি। কমপক্ষে ডিসি ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা হয়। আমি ১৫ জুন দায়িত্ব পাওয়ার পর নওগাঁয় দুবার গিয়ে সাতদিন থেকে এসেছি। আমি দায়িত্বটা পালনের চেষ্টা করছি। আমরা কর্মকর্তারা ভয় পেলে তো সাধারণ মানুষ আরও বেশি ভয় পেয়ে যাবে।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব মো. নূর-উর-রহমান পেয়েছেন গাইবান্ধা জেলার দায়িত্ব। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওখানে কোভিড-১৯ ম্যানেজমেন্টটা ঠিকই আছে। করোনা রোগী বেশি নেই। হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসার বিষয়গুলো আমি দেখে এসেছি। দুই দফা সেখানে গিয়েছি। এখান থেকে প্রায় প্রতিদিনই ফোনে, জুমে কথা বলা হয় সবার সঙ্গে।’

তিনি বলেন, ‘গাইবান্ধায় এখন দিনে চার-পাঁচজন রোগী পাওয়া যাচ্ছে। সংক্রমণের হার কমে এসেছে, নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। সমন্বয়টা আমরা ঠিকভাবেই করছি।’

লালমনিরহাট জেলার দায়িত্ব পেয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম। তিনি সমন্বয় করে কীভাবে কাজ করছেন জানতে চাইলে লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. মোতাহার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগও হয়নি, আমরা জানিও না। তার (পার্বত্য সচিব) সঙ্গে আমি এখনো কোনো মিটিং করিনি। এখানে করোনা সংক্রমণ কখনো বাড়ছে, আবার কখনো কমছে। টেস্ট করলে বাড়ে, টেস্ট না করলে কমে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, ‘লালমনিরহাটের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো। গত ১০ দিন ধরে ওখানে সংক্রমণের ঝোঁকটা একটু বেশি। লালমনিরহাটে কোরবানির পশুর হাট ও বাজারে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঈদের সময় বাইরে থেকে যারা আসবে তাদের বিষয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘পাটগ্রাম পৌরসভায় হঠাৎ করে আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে, এজন্য সংখ্যাটা একটু বেশি হয়েছে। তাই ওখানে স্পেশাল মেজার্স নেয়া হয়েছে। সেখানে গত রোববার পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০৫ জন, গত কয়েকদিনে সংখ্যাটা বেড়েছে।’

‘সরেজমিনে গিয়ে আমি ওখানে কয়েকবার সভা করেছি। টেলিফোনেও কথাবার্তা হচ্ছে।’

সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তার সঙ্গে তো আমাদের অনেকবার কথা হয়েছে। তিনি আমাদের পরামর্শ দিচ্ছেন, অনেক কিছু করছেন। তিনি অনেক সিনিয়র মানুষ। আনুষ্ঠানিক মিটিং হয়তো অনেকের সঙ্গে হয় না।’

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘আমাদের জেলার সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ। তিনি দু’বার আমাদের এখানে এসেছেন, করোনা প্রতিরোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের সঙ্গে সভা করেছেন। এছাড়া ভার্চুয়ালি কথা তো হয়ই। আমাদের মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২৫৬ জন। এরমধ্যে ১৭৮ জন সুস্থ হয়ে গেছেন।’

চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সচিব স্যার আমাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে পাঁচটি সমন্বয় সভা করেছেন। পাঁচটি মিটিংয়ের একটি হয়েছে জুমে, অন্যগুলো সবাই একসঙ্গে বসে করেছি। আমাদের সমস্যা বা চাহিদার কথা জানালে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা ডিজি অফিসে সেই বিষয়ে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা করেন।’

সিভিল সার্জন আরও বলেন, ‘ঢাকার পরেই চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে গত ১০-১২ ধরে আমরা একটু স্বস্তিতে আছি। পজিটিভিটির রেট ছিল একসময় ৩০-৩৩ শতাংশ, এখন সেটা ১৯ থেকে ২২-এর মধ্যে থাকছে। তবে আমরা এখনই স্বস্তি প্রকাশ করছি না, কারণ সামনে কোরবানির ঈদ। ঈদের সময় মানুষের চলাচল বাড়বে, পশুর হাট বসবে, কোরবানির মাংস বিতরণ হবে। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছি।’

মৌলভীবাজারের সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান। তিনি গত ১১ জুলাই মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক কার্যক্রম পরিদর্শন এবং মতবিনিময় সভা করেন।

আরএমএম/এইচএ/পিআর