অর্থনীতি

প্রভাবশালীদের প্রভাবে ডিএসইতে অতিরিক্ত জনবল

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রয়োজনের তুলনায় ৭০-৮০ জন অতিরিক্ত জনবল রয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

Advertisement

অভিযোগ রয়েছে, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের (মালিক থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক) আগে ডিএসইর প্রভাবশালী সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়েছেন। এমনকি কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দেয়ার নজরিও রয়েছে।

ডিএসইর বিভিন্ন পদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়োজন না থাকার পরও প্রভাবশালী সদস্যদরা ডিএসইর পরিচালক পদে এসে ইচ্ছামতো পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়েছেন। যার ফলে এখন ডিএসইতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল দেখা দিয়েছে।

রকিবুর রহমান, আব্দুল হক, আহমেদ রশীদ লালী, মিনহাজ মান্নান ইমনসহ কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য বিভিন্ন সময়ে প্রভাব খাটিয়ে তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়েছেন বলে ডিএসইর একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন।

Advertisement

ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালে এক্সিকিউটিভ পদে ৪০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে ৩৯ জনকে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়।

‘তবে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হয় এক জনকে। পরবর্তী ওই কর্মকর্তা দফায় দফায় পদোন্নতিও পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি ডেপুটি ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ডিএসইর ওই কর্মকর্তা প্রায় ৪ মাস অফিসে না এসেই বেতন-ভাতা ভোগ করেন। এ নিয়ে ডিএসইর কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা হয়। যার প্রেক্ষিতে মানব সম্পদ বিভাগ ওই কর্মকর্তাকে শোকজ করে। কিন্তু ব্যাখ্যা না পাওয়ায় পরবর্তীতে ডিএসইর ম্যানেজমেন্ট তার বেতন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত জানার পর তিনি এক দিন অফিসে এসে কিছু সময় থেকে আবার চলে যান।

এ বিষয়ে ডিএসইর আরেক কর্মকর্তা বলেন, ডিএসইর এমন অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা প্রভাবশালীদের সুপারিশে কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন। তারা কাজে ফাঁকি দিয়ে ঊর্ধ্বতনদের তোষামোদ করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যাচ্ছেন। পদোন্নতিও পাচ্ছেন। অথচ যারা নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করছেন তারা বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন।

Advertisement

ডিএসইর আর এক কর্মকর্তা বলেন, এই করোনা মহামারির সময় হিসাব করা হচ্ছে ডিএসইতে অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। অথচ প্রভাবশালী সদস্যরা যখন তাদের ইচ্ছামতো পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়েছেন তখন কোনো কিছুই হয়নি। এখন সংকটের মধ্যে ছাঁটাই, বেতন কাটার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে যা খুবই দুঃখজনক।

প্রভাবশালীদের প্রভাবে অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দেয়া সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক রকিবুল রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কে কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন সেটা বিষয় না। কে কেমন কাজ করছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। প্রত্যেককে তার কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে।

তিনি বলেন, ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশনের পর বর্তমানে ডিএসইর যে অবস্থা তাতে খরচ কমানোর বিকল্প নেই। তবে আমাদের অবস্থান হচ্ছে আমরা একজনকেও ছাঁটাই করব না। অন্যভাবে খরচ কমানোর চেষ্টা করা হবে।

একই অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডিএসইর সাবেক পরিচালক আহমেদ রশীদ লালীর মোবাইলে ফোন দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। আর বর্তমান পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন একটি মামলায় জেলে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত স্টক এক্সচেঞ্জ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে ২০১৩ সালে ডিমিউচ্যুয়ালাইজড হওয়ার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয় ডিএসই। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জটিকে লভ্যাংশ বিতরণ করতে হচ্ছে। তবে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সঙ্গতি না থাকায় নামমাত্র লভ্যাংশ পাচ্ছেন শেয়ারহোল্ডারা। প্রথম তিন বছর রিজার্ভ ভেঙে শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দেয় ডিএসই। তবে শেষ দুই বছরে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ। কারণ এই অর্থবছরের পুরোটা সময়ই লেনদেন ছিল মন্দা। এ পরিস্থিতিতে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ৬৬দিন লেনদেন বন্ধ ছিল। ফলে এ হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডররা কোনো লভ্যাংশ পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে খরচ কমানোর তোড়জোড় শুরু করেছে ডিএসই।

এর অংশ হিসেবে গত মাসে স্বতন্ত্র পরিচালক সালমা নাসরিনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ডিএসই। কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়- স্বতন্ত্র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান, মুনতাকিম আশরাফ, অধ্যাপক ড. এ কে এম মাসুদ এবং ডিএসএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ছানাউল হককে।

এ কমিটিকে কর্মীদের কাজের পরিমাণ ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে বেতন কাঠামো পর্যালোচনা করতে বলা হয়। সেই সঙ্গে বিভাগভিত্তিক কী পরিমাণ মানবসম্পদ প্রয়োজন এবং কী পরিমান অতিরিক্ত বা ঘাটতি আছে তাও মূল্যায়ন করতে বলা হয়।

এ কমিটি গত রোববার ডিএসইর পর্ষদে তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ প্রতিবেদনে উঠে আসে, ডিএসইতে প্রয়োজনের তুলনায় ৭০-৮০ জন বেশি জনবল রয়েছে।

এর প্রেক্ষিতে ডিএসইর ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কাছে অতিরিক্ত জনবলের ব্যাখ্যা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ। ৩ কার্যদিবসের মধ্যে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আগামী ১৬ জুলাই আবার পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হবে।

ডিএসইর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসইতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ৩৬০ জন। তবে প্রধান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (সিআরও) পদে বর্তমানে কেউ নেই। এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে প্রতিমাসে ডিএসইকে ৩ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে বছরে ব্যয় হচ্ছে ৩৮ কোটি টাকা।

এই অর্থের বড় শতাংশই নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে রয়েছেন- ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এবং প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও)।

এদের মধ্যে সিএফও এবং সিটিও পদ দু’টিতে দায়িত্ব পালনকারীরা প্রথমে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগে ডিএসইতে ঢোকেন। তবে পরবর্তীতে তারা তাদের পদ স্থায়ী করে নেন। পদ স্থায়ী করা হলেও তাদের বেতন কাঠামো নতুন করে পুননির্ধারণ করা হয়নি। উল্টো চুক্তিভিত্তিক উচ্চ বেতনের সঙ্গে তারা নিয়মিত কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে।

ডিএসইর এমডির পেছনে প্রতি মাসে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হচ্ছে ১২ লাখ টাকা। ২ লাখ টাকা মূল বেতনে নিয়োগ পাওয়া সিএফও এখন মোট বেতন নিচ্ছেন ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্রাচ্যুইটি, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, কার রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভার, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা প্রিমিয়াম, মোবাইল বিল মিলিয়ে প্রতি মাসে আরও প্রায় ২ লাখ টাকা পান তিনি। সব মিলিয়ে সিএফও’র পিছনে প্রতি মাসে ডিএসইর ব্যয় হচ্ছে ৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা।

একই অবস্থা সিওও এবং সিটিও পদ দু’টির ক্ষেত্রেও। ২ লাখ টাকা মূল বেতনে ডিএসইতে যোগদান করা সিটিও বর্তমানে মোট বেতন পান ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। আর ২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা মূল বেতনে যোগ দেয়া সিওও মোট বেতন পান ৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গ্রাচ্যুইটি, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, কার রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভার, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বীমা প্রিমিয়াম, মোবাইল বিল মিলিয়ে প্রতি মাসে তারা আরও প্রায় ২ লাখ টাকা পান। ফলে এই দুই কার্মকর্তার পেছনেও প্রতি মাসে ডিএসইর সাত লাখ টাকার ওপরে খরচ করতে হয়।

এমএএস/এমএফ/জেআইএম