করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা ও আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি হেলথকেয়ার) নামক প্রতিষ্ঠানের নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর অঘোষিত স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।
Advertisement
‘মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতর রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছে’ মর্মে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গতকালের (১১ জুলাই) দেয়া বক্তব্যের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির আগে কী কী বিষয় বিবেচনা করা হয়েছিল, চুক্তির পর শর্তগুলো প্রতিপালনে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল এবং মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা বলতে কী বোঝানো হয়েছে, এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে দিতে বলেছে মন্ত্রণালয়।
রোববার (১২ জুলাই) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ-২ শাখার উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরাও চাই, সত্যি ঘটনা প্রকাশিত হোক, কোন পরিস্থিতিতে, কার নির্দেশে কখন এবং কীভাবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি হলো তা প্রকাশিত হোক। শুধু রিজেন্ট হাসপাতাল কেন, জেকেজিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কীভাবে অনুমোদন পেয়েছে সে তথ্য-উপাত্তও নেয়া হোক।’
Advertisement
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মো. সাহেদ ও জেকেজি- এ দুটি প্রতিষ্ঠানে করোনার নমুনা পরীক্ষার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ায় স্বাস্থ্য সেক্টরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির আরও অনেক ঘটনা বেরিয়ে আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। ঘটনা ফাঁস হওয়ার আগে মো. সাহেদ ও জেকেজি চেয়ারম্যান তথা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা চৌধুরী স্বাস্থ্য সেক্টরে দাপটের সঙ্গে চষে বেড়িয়েছেন।
একাধারে পত্রিকার সম্পাদক, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ নানা পরিচয়ের অভিযুক্ত প্রতারক মো. সাহেদ কীভাবে কার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেক্টরে আবির্ভূত হলেন, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সেক্টরে কার সঙ্গে তার দহরম-মহরম বেশি ছিল, কী কারণে বেশি ছিল ইত্যাদি কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মো. সাহেদের সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালীদের সঙ্গে সখ্যতা কীভাবে স্থাপিত হলো, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ও স্বাস্থ্যবিভাগের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সচিবের মাধ্যমে মো. সাহেদ স্বাস্থ্য অধিদফতরে যাতায়াত শুরু করেন। তৎকালীন সচিবের সুপারিশেই রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি হয়। হাসপাতালটিতে করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর সেবা প্রদানের জন্য আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল না থাকা সত্ত্বেও সুপারিশের কারণে রোগী ভর্তি ও সরকারি ল্যাবরেটরি থেকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দেয়া হয়! এ বিষয়টি তুলে ধরে ব্যাখ্যা দেয়ার পরদিন আজ স্বাস্থ্যসচিব স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
এদিকে জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনাও বিএমএর একজন প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় দাপটের সঙ্গে সরকারি চাকরির পাশাপাশি জেকেজি গ্রুপ চালিয়ে আসছিলেন। ওই নেতার সুপারিশেই ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সপ্তাহ পালনের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ ভাগিয়ে নিয়েছিল জেকেজি গ্রুপ।
Advertisement
একইভাবে করোনার নমুনা পরীক্ষার অনুমতি নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ডা. সাবরিনা ও তার স্বামীর এ প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫ হাজারের বেশি ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। তার স্বামী ডা. আরিফকে পুলিশ গ্রেফতার করে, বর্তমানে তিনি জেলে আছেন।
ডা. সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান হলেও তিনি এখন তা অস্বীকার করছেন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি গ্রেফতারের আগে পর্যন্ত আজও (১২ জুলাই) জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নেয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ডা. সাবরিনাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোববার (১২ জুলাই) মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়।
এমইউ/বিএ/এফআর