কৃষি ও প্রকৃতি

মাছ শিকারের নানা পদ্ধতি

বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

Advertisement

‘মৎস্য মারিব, খাইব সুখে’- সুখী ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ প্রাচীন বাংলার লোকমুখে বহুল প্রচলিত প্রবাদ। বাঙালি ও মাছ তাই একে অন্যের পরিপূরক। মাছ নিয়ে বাঙালির মনের কোণে আছে তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা। একজন বাঙালি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, মাছ তাকে কাছে টেনে নেবেই। তাই তো ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ যেন বাঙালি জীবনের ঐতিহ্য বহন করে।

তাই মাছ শিকারও যেন বাঙালি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামাঞ্চলে মৌসুমী জলাশয় বা বিলে নানা সরঞ্জাম দিয়ে বা সরঞ্জাম ছাড়া প্রায়ই মাছধরা একটি সুপরিচিত দৃশ্য। বাংলাদেশে মাছধরার চিরায়ত প্রধান পদ্ধতিগুলো হলো:• জখম করার হাতিয়ার: এ ধরনের সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বর্শাজাতীয় হাতিয়ার, যা ছোড়া যায় অথবা যা দিয়ে সরাসরি মাছ গাঁথা হয়।• টানাবড়শি: স্বাদুপানিতে ও সমুদ্রে লম্বা সুতার টানাবড়শি এবং ছিপে বড়শির ব্যবহার, গ্রামের ধানক্ষেতে ও বিলে অনেকগুলো বড়শিসহ একটি দীর্ঘ সুতা ভাসিয়ে রাখা ইত্যাদি বাংলাদেশের বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের সাধারণ নমুনা। বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে মাছকে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম টোপ দিয়ে আকৃষ্ট করা হয় অথবা চারা ফেলে প্রলুব্ধ করা হয়।• মাছ ধরার ফাঁদ: গ্রামাঞ্চলে বাঁশের শলা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের চাঁই তৈরি করা হয়। এতে থাকে বিভিন্ন আকৃতির খোপ। এতে মাছ ঢোকানোর কৌশল আছে, কিন্তু বের হওয়ার কোন উপায় নেই। গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে বন্যার সময় লোকে মাছ ধরার ফাঁদ পাতে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ফাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইকবর চাঁই, বুচনা, বেগা, ডুবা ফাঁদ, দারকি, উন্টা, তেপাই, ধীল, চেং, চাঁই, চান্দি বাইর, বানা, পলো, রাবনি, চারো ইত্যাদি।• জাল: আকার ও আকৃতি, ফোকরের আয়তন, পানিতে পাতার অবস্থান ও ব্যবহার পদ্ধতির ভিত্তিতে বাংলাদেশে ব্যবহৃত জালকে নানাভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। যেমন- ব্যাগজাল, ভাসাজাল, ঝাঁকিজাল, ধর্মজাল, ফলিং নেট ইত্যাদি।

বড়শি, বিভিন্ন ধরনের জাল, টেটা বা কোঁচ, পলো, ঘূর্ণি, গৃহপালিত ভোঁদড় ইত্যাদি দিয়ে মাছ শিকারের কতশত গল্প যে বহন করে চলছে বাঙালি জীবন! মাছধরার বিভিন্ন পদ্ধতি সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে, তবে চলুন পৃথিবীর বেশ কিছু দেশের মাছ ধরার প্রথাগত পদ্ধতির রাজ্যে ডুব দিয়ে আসি।

Advertisement

ভোঁদড় দক্ষ মাছ শিকারী: নদীমাতৃক বাংলাদেশে ভোঁদড় (আঞ্চলিক ভাষায় ধাড়িয়া বা ধেড়ে) দিয়ে মাছ শিকার করা বেশ পুরোনো ও প্রাকৃতিক পদ্ধতি। তবে কালের বিবর্তনে এ পদ্ধতি আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবনের নদীগুলোর তীরে বসবাসকারী এবং নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ের বেশ কিছু জেলে পরিবার এখনো ‘ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার’র প্রথা টিকিয়ে রেখেছে। জেলেদের নৌকার একপ্রান্তে বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি করা ঘরে ভোঁদড় আটকে রাখা হয়। মাছধরার জন্য ত্রিভুজ আকৃতির জাল ব্যবহার করেন। নদীতে জাল ফেলার সময় ভোঁদড়ের ঘরের দরজা খুলে জালের দু’পাশে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয়। পানিতে নেমে ভোঁদড় মাছকে তাড়িয়ে জালের মধ্যে নিয়ে এলে জেলেরা জাল টেনে ডাঙায় ওঠান। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত নৌকা আর ভোঁদড় নিয়ে নদীপথে পাড়ি জমান স্থানীয় জেলেরা। ভোঁদড়কে এ পরিবারগুলো অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখির মত লালন-পালন করেন। শিকারে যাওয়ার আগে ভোঁদড়কে মাছ খাওয়ানো হয়। আবার জালে যেসব মাছ ধরা পরে তার একটি অংশও ভোঁদড় পায়। ফলে সে জেলেদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে।

টেটা বা কোঁচ দিয়ে মাছ শিকার: এটি একটি দীর্ঘ বর্শার মত যন্ত্র, যা মাছ শিকারে ব্যবহৃত হয়। মাছের উপর বেশ খানিকটা দূর থেকে টার্গেট করে টেটা নিক্ষেপ করে শিকার করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিলে প্রতিবছর আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত যেসব যন্ত্র দিয়ে মাছ ধরা হয়, তার মধ্যে কোঁচ অন্যতম। বর্শা জাতীয় দশ-পনেরোটি অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ ধারালো গোলাকার লোহার টুকরো বাঁশের চোখা অগ্রভাগগুলোর মাথায় পরিয়ে দিয়ে কোঁচ বানানো হয়। দূর থেকে নিক্ষেপযোগ্য করার জন্য অপর একটি বাঁশের সাথে এ অংশ জোড়া দেওয়া হয়। মাছ শিকারীরা দূর থেকে মাছ ধরার এ যন্ত্র মাছকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে ঘায়েল করে বড় বড় মাছ শিকার করেন। অনেকে লোহার অগ্রভাগে কালা বা আল তৈরি করে নেন। যেন কোঁচ এককাঁটা বা তেকাঁটায় বিদ্ধ হওয়া মাছ ছুটে যেতে না পারে। মাছ ধরার আধুনিক অনেক উপকরণ বা যন্ত্র আবিষ্কার হলে কোঁচের ব্যবহার অনেক কমে এলেও এর আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এটি আমাদের প্রাচীনকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

কর্মরেন্ট পাখি দিয়ে মাছ শিকার: চীন, জাপান ও কোরিয়ায় কর্মরেন্ট পাখি দিয়ে মাছ শিকার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। লম্বা ও শক্তিশালী ঠোঁট বিশিষ্ট, জলজ শিকারি পাখি কর্মরেন্ট। সাধারণত ছোট একটি কাঠের তৈরি ভেলা এবং সঙ্গে বেশ কয়েকটি কর্মরেন্ট নিয়ে শুরু হয় জেলেদের মাছ ধরার অভিযান। তারপর পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয় এ পাখি। তবে এর আগে কর্মরেন্টের গলা এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে তারা মাছ গিলতে না পারে। মাছ শিকারে দক্ষ পাখিগুলো কখনোই মাছ ছাড়া উপরে উঠে আসে না। আর গলায় বাঁধন থাকার কারণে বড় মাছ ঠোঁটে নিয়ে উপরে উঠে আসতে হয়। তারপর পাখিদের ঠোঁট থেকে মাছটি সরিয়ে নেওয়া হয়। সাধারণত কিছু সময়ের মধ্যে বড় সাইজের ডজনখানেক মাছ ধরে নিতে পারে এ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মরেন্ট।

হাঁসের বাচ্চা দিয়ে মাছ শিকার: কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের গ্রামগুলোতে হাঁসের তুলতুলে বাচ্চা দিয়ে মাছ শিকার করা নিত্যকার একটি পদ্ধতি। প্রথমে একটি বড়শির টোপের কাছাকাছি জায়গায় হাঁসের বাচ্চা বেঁধে পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর বাচ্চাটা হয়তো স্বভাবমত বা ভয়ে তীব্র ডাকাডাকি শুরু করে। বাচ্চার ডাক শুনে মাছ এসে টোপ গিলে নেয়। এরপর বাচ্চাসহ ভারি মাছটাকে টেনে তোলা হয়। আর টানতে গিয়ে বাচ্চার পেটে প্রবল চাপ পড়ে। আবার অনেক সময় বড়মাছ টোপসহ বাচ্চা গিলে খেয়ে ফেলে। দৃশ্যটি দেখার অভিজ্ঞতা ভিন্নরকম হলেও হাসের বাচ্চার কষ্ট হৃদয় ছুঁয়ে যেতে বাধ্য।

Advertisement

‘গোল্ডেন মহাশের মাচ্ছা’ শিকার: ভরা বৃষ্টির সময় নেপালের পাহাড়ি নদী নতুন করে যৌবন ফিরে পায়। নদীর বেশি গভীর, বরফ জমা ও বিপদসঙ্কুল অংশ থেকে কম গভীর ও পাথুরে অংশে স্রোতে ভেসে এসে আটকা পড়ে নানা জাতের মাছ। এর মাঝে বেশি আসে বেশ বড় বড় আকারের ‘গোল্ডেন মহাশের মাচ্ছা’। বৃষ্টির দিনে ছিপ নিয়ে পাহাড়ি নদীতে মাছধরায় মেতে ওঠে নেপালি কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা। এর মাঝে রয়েছে প্রচণ্ড এক উত্তেজনা ও নিখাদ আনন্দ। দুষ্টু মাছেরাও নেয় ধৈর্যের চরম পরীক্ষা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় ছোট ছোট আছলা মাচ্ছা যা দেখতে বাংলাদেশের বাটা মাছের মতো। কিন্তু সবার আগ্রহ থাকে বড় মহাশের মাচ্ছার জন্য। একটি পেলেই মিনিমাম ৭-৮ কেজি মাছের ব্যবস্থা। মহাশের মাচ্ছা নেপালে নারিকেল কুচি, পেঁয়াজ, ধনিয়া ও কমলা পাতা দিয়ে রান্না করা হয়। এর ফলে একটি দারুণ ফ্লেভার ও স্বাদ পাওয়া যায়।

খুঁটিতে বসে বসে মাছ শিকার: শ্রীলঙ্কার কঙ্গলা দ্বীপ ছাড়াও আরও কয়েকটি দ্বীপে খুঁটি পুঁতে মাছ শিকার করার ঐতিহ্য প্রচলিত আছে। প্রায় শত বছর ধরে চলে আসা এ পদ্ধতিতে প্রথমে সমুদ্র উপকূলের অল্প পানিতে বড় একটি খুঁটি শক্ত করে পুঁতে দিতে হয়। যার উপর ছোট্ট একটি বসার জায়গা থাকে। যেখানে একজন মানুষ বসে মাছ শিকার করতে পারবে। পদ্ধতিটি তেমন লাভজনক না হলেও একটি ছোট্ট পরিবারের একদিন দিব্যি চলে যায়। ২০০৪ সালের সুনামিতে এ দ্বীপের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর থেকে এ পদ্ধতিতে মাছধরা অনেকটাই কমে গেছে। জেলেরা আস্তে আস্তে অন্য পদ্ধতি বা পেশায় চলে যাচ্ছে। তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মাছধরার ঐতিহ্যটি।

লেখক পরিচিতি: তিনি পেশাগত জীবনে একজন ফার্মাসিস্ট এবং ব্র্যান্ড ম্যানেজার। সমাজকর্মী হিসেবে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছেন রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, বেটার মাইন্ডস ও গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের (নেপাল) সাথে। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়েও তিনি প্রচণ্ড আগ্রহী এবং প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন।

এসইউ/পিআর