মতামত

করোনা নেগেটিভ সনদ এবং ভিনদেশে বাংলাদেশ

ইতালির নাগরিকরা এখন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। ৩৫ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যুর ক্ষত শুকায়নি। তবুও ইতালি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে এখন। করোনা আতঙ্ক তারা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ইতালিতে বাস করা বাংলাদেশিরা আনন্দভ্রমণ করছেন এ চিত্রটা আমরা দেখছি।

Advertisement

কিন্তু এরই মাঝে নতুন উদ্বেগ নিয়ে এলো আমাদের বাংলাদেশিরা এই ইতালিতে। বাংলাদেশ থেকে বিশেষ ফ্লাইটে করোনা আক্রান্ত হয়ে অনেকেই ফিরছেন ইতালিতে। তথ্যগোপন করে ইতালিতে এসে তারা উঠছেন বাসাবাড়িতে। ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্যদের মাঝেও। রাজধানী রোমে বাংলাদেশ থেকে আসা করোনা আক্রান্ত এক প্রবাসী আক্রান্ত করেছেন তার বাসার আরও চারজনকে গত সপ্তাহে। ফ্লোরেন্স, বলনিয়া, আনকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৫০ জনের আক্রান্তের খবর দিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এই হলো অতিসম্প্রতি ইতালিতে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের চিত্র।

ইতালিতে বাংলাদেশিরা এখন নতুন আতঙ্কের নাম। এই আতঙ্ক ছুঁয়েছে দেশটির গণমাধ্যমেও। অথচ যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, উড়োজাহাজ উড়বে, বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হবে, আটকে পড়া মানুষগুলো ফিরে আসবে আবার। কিন্তু না, বাংলাদেশের সাথে ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে ইতালি সরকার। এছাড়া পথও নেই। শূন্যের কোটায় করোনায় মৃত্যু নেমে আসেনি যদিও, কিন্তু ৫০ এর নিচে নেমে এসেছিল নিত্যদিনের মৃত্যুর সংখ্যা। যেখানে দেশটি জয় করছিল করোনাকে, সেখানে করোনার পুনর্জীবন দিচ্ছেন কতিপয় বাংলাদেশি।

এই বাংলদেশিরা ফিরে এসেছেন, নিয়ে এসেছেন করোনা নেগেটিভ সনদ। তবুও কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা, কিন্তু না। তাদের অনেকেই তা মানছেন না। সে জন্যই আজ সারা ইতালিতেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বাংলাদেশিরা আলোচিত এবং বহু সমালোচিত। সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটেছে ৮ জুলাই। কাতার এয়ারওয়েজের একটা বিমানের ১২৫ জন বাংলাদেশি আরোহী ইতালিতে প্রবেশ করতে পারেননি। ইতালির স্বাস্থ্যবিভাগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওইদিনই যাত্রীদের তারা ফেরত পাঠায়।

Advertisement

৮ জুলাই-ই সারা পৃথিবী জেনেছে কীভাবে বাংলাদেশের খোদ রাজধানীতেই করোনা নেগেটিভ সনদ দেয়া হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ রকম রিপোর্ট এসেছে। একজন চিকিৎসা বেনিয়ার কারণে সারা বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে করা হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু তাই নয়, সারাদেশটাই উঠে গেল দুর্নীতির কাঠগড়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রতি ইতালির মানুষদের ছিল সন্দেহের তীর। এই তীর বিদ্ধ হলো এখন সবার বুকে বিমান থেকে ওই ১২৫ জন যাত্রী নামার অনুমতি না পেয়ে।

এই তীরটা বিদ্ধ হওয়ার প্রধান কারণই এর আগের দিনের বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম। যাকে নিয়ে এই শিরোনাম, সেই শাহেদ নামের নাদুসনুদুস মানুষের ছবিটার গায়ে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দলটির তকমা। এই মানুষটা সরকারি দলের মন্ত্রী-নেতা সবার চোখ টপকিয়ে দলের একটা উচ্চাসনে জায়গা করে নেয়ার মাঝে কি কোনো বিস্ময় আছে। আসলে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই নেই। কারণ এই মানুষটা চৌকস, তার স্মার্টনেস এতই পরিপক্ব যে, সে কিনে নিতে পেরেছে সব। কখনো মেজর, কখনো সচিব, এবং সবসময় সে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য।

একটা দলের পরিচয় একজন মানুষকে মহান করে তোলে। আবার ওই দলীয় পরিচয়েই জিকে শামীম, পাপিয়ারা শুধু লুটেরাই হয়নি, তারা শুধু সাধারণ মানুষকেই ঠকায়নি, সারা জাতিকে কলঙ্কিত করছে। আর শাহেদ যেটা করেছেন, তা হলো সারা বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত করতে সরাসরি কাজ করেছেন। এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ে সারা বাংলাদেশই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে। কারণ তার নিউজ প্রকাশিত হওয়ার প্রথম ধাক্কাটি লাগে পরদিনই ইতালিতে।

শাহেদ কত হাজার কোটি টাকা বানিয়েছেন, সে তো দুদক জানবে পরে, না-ও জানতে পারে। এই বাংলাদেশে অনেক কিছুই অন্তরালে থেকে যায়। কিন্তু ওই যে ১২৫ জন মানুষ ফিরে গেল ইতালি থেকে কিংবা যারা ইতালি গিয়ে ভাইরাস ছড়াল, কিংবা ভুয়া সনদের কারণে করোনা রোগীরা ঘুরে বেড়িয়েছে দেশ থেকে বিদেশে, ছড়িয়েছে ভাইরাস। এমনকি মৃত্যুও হয়েছে। অন্যদিকে ওই কারণে কিংবা শাহেদের মতো আরও কতিপয় অসাধু চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের কারণে সারা বাংলাদেশটাই বিদেশিদের কাছে প্রতারক হিসেবে লেভেলিং হয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

দেশের প্রতি ভিনদেশিদের এই যে অবজ্ঞা কিংবা হেয় করার জন্য হয়তো আমরা তাকে দায়ী করতে পারি। কিন্তু দায়ভার শুধুই কি তার ওপর বর্তায়। শাহেদরা এমনিতেই বেড়ে ওঠে না। তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়, সে জন্যই তারা বেড়ে ওঠে। দলের অভ্যন্তরে কীভাবে ঘাপটি মেরে বসেছিলেন শাহেদ এবং দলের তকমাই তাকে প্রমোট করেছে, টক শোতে ঠেলে দিয়েছে, আর এই সব কিছুই পর্বতপ্রমাণ ক্ষমতায় তাকে নিয়ে গেছে। যে ক্ষমতায় তিনি মানুষকে হত্যা করার সার্টিফিকেট বিতরণ করেছেন এমনকি পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা অনৈতিক বাংলাদেশিদের কাছেও।

আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, শাহেদ পলাতক হওয়ার পর এখন দেশের বড় একটা অংশ তার সাথে হাওয়া ভবনের সংযোগ আবিষ্কার করছেন। হাওয়া ভবন বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্নীতির এক অভয়াশ্রমের নাম। এই অভয়াশ্রমের নাম শুনলেই মানুষ খুঁজে পায় দুর্নীতিবাজদের। সেই ভবন থেকে বেরিয়ে এসে আজ কীভাবে দেয়াল টপকাচ্ছে তারা, ঢুকে যাচ্ছে তারা 'আলোকিত ভবনে'।

চোর-ডাকাত-লুটেরা-বেনিয়া সবসময়ই সুযোগ খোঁজে। তার কাছে আদর্শ একটা ট্রাম্প কার্ড। এই কার্ড সে ব্যবহার করে তার প্রয়োজনে। দুর্নীতি, টাউটি, চুরি, লুট, ব্যাংক ডাকাতি যারা করে, তারা ওই একই বৃত্তের মানুষ। হাওয়া ভবন কিংবা এখনকার অন্য কোনো অনুচ্চারিত ভবন বলি না কেন সব জায়গায়ই প্রবেশাধিকার করে নেয় এরা। এরা অনুপ্রবেশকারী নয়। এরা প্রবেশ করে বুকটান করেই। যা কিছু করার তা করেই উচ্চ জায়গা থেকেই এরা অধিকার পায়।

সুতরাং তার লিংক কোথায় ছিল, এ ছুতো খুঁজে মূল অপরাধকে আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। ওই হাওয়া ভবনের সংযোগ খুঁজতে গিয়ে এদের নতুন করে পুনর্বাসিত কিংবা জায়েজ করার অন্ধখেলা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শাহেদরা যে প্রভাব-প্রতিপত্তি-ক্ষমতা-সন্ত্রাস দিয়ে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম করছে, সাধারণ মানুষের শ্রম-ঘামের অর্থ দিয়ে বানাচ্ছে যে সম্পদের পাহাড়, সেই উৎসের সন্ধানেই যেতে হবে। হোক না সে উৎস কঠিন দেয়ালে আবদ্ধ কোনো শক্তিমান দেবতা।

এইচআর/বিএ/এমএস