কথায় বলে, দুঃসময়ে এসে চেনা যায়, কে আপন বা কে পর। করোনার এই সময়ে শুধু আমি বা আপনি কেন বাংলাদেশ বা পুরো পৃথিবীর মানুষ যেন চিনে ফেলছে কে আর আপন বা কে তার পর। সংবাদমাধ্যমে আমরা প্রতিদিন দেখছি শহর ছাড়ছে মানুষ। খালি হচ্ছে বড় বড় দালানগুলো, অসংখ্য স্মৃতিগাঁথা ও চোখ ভিজে আসা গল্পও লেখা হচ্ছে। কিন্তু দুঃসময়ের মধ্যেও বেরিয়ে আসছে অমানবিক বাড়িওয়ালাদের গল্প। আবার মানবিক গল্পও যে নেইনা তা নয়, কিন্তু খারাপ উদাহরণের কাছে ভালোগুলো মার খেয়ে যাচ্ছে।
Advertisement
ঢাকা শহরের ইতিহাস সম্পর্কে যারা জানেন বা এখনো অনেক বয়োবৃদ্ধের গল্প থেকে জানি, এখানকার অনেক অঞ্চলই এক সময় জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বসতি বাড়তে থাকে। এর কারণ অবশ্য এই যে, রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এই শহরে বা অনেক অনেক বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস এখানে। এছাড়া নাগরিক সুযোগ সুবিধা যা আছে, তাও এই শহরে। তাই এতো ঘনবসতি, এত কষ্টের জীবন, যাপন ছেড়ে কেউ যেন নড়তে চায় না। এতে পোয়াবারো হয়েছে বাড়িওয়ালাদের। তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়া বাড়ান, যখন খুশি ভাড়াটিয়া বের করে দেন, আর ব্যাচেলর হলে তো কথায় নেই।
বাড়িওয়ালারা এমনই পেয়ে বসছিল যেন, ইহজীবনের তাদের আর কোনো ধরনের সমস্যায় পড়ার আশঙ্কাই তৈরি হবে না! কিন্তু করোনা উল্টো শিক্ষা দিয়ে গেল। এখন চারপাশে এত এত টু লেট ঝুলছে যে, এটাই একটা বিস্ময়! কিন্তু এতেও কি বাড়িওয়ালারা মানবিক হয়েছেন? কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ কিন্তু তা বলে না। প্রথমদিকে বাড়িওয়ালারা করোনা হয়েছে শুনলে ভাড়াটিয়াদের বের করে দিতে চাইতেন। তেমনি বাইরে কাজ করেন, পুলিশ, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক এমন অনেককে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বা বের হয়ে যেতে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। সেই সময় কিছুটা কাটিয়ে এখন যখন সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে, বেরিয়ে আসছে বাড়িওয়ালাদের নানা ভয়ংঙ্কর কাহিনী।
রাজধানীর কলাবাগানের ওয়েস্টার্ন স্ট্রিটের একটি বাড়ির নিচতলায় মেসে থাকা আট শিক্ষার্থীর তিনটি কক্ষের তালা ভেঙে তাদের শিক্ষাসনদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনপত্র, বই-খাতাসহ যাবতীয় মালামাল ময়লায় ফেলে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। মাত্র ৩৫ হাজার টাকার জন্য একজন সাবেক ব্যাংকার বাড়িওয়ালা এই কাজটি করেছেন। একইভাবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ শিক্ষার্থী তিন মাসের ভাড়া না দেয়ায় তাদের শিক্ষাসনদ ও মালামাল গায়েব করে দিয়েছে পূর্ব রাজাবাজারে আলিফ নামের একটি ছাত্রাবাসের মালিক খোরশেদ আলম। এসব ঘটনায় মানববন্ধনও হয়েছে।
Advertisement
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আইসোলেশনে থাকা এক রোগীকে গভীর রাতে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় বাড়িওয়ালা। পরে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে তাকে আবার বাসায় তুলে দেয়া হয়। সিদ্ধিরগঞ্জে পোশাকশ্রমিক দম্পতিকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এক বাড়িওয়ালা। স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় দুজনকেই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। এক হাজার টাকা ভাড়া বাকি থাকায় সাভারে এক ভাড়াটিয়াকে বের করে দেয়া হয়েছে। চকবাজারে ভাড়া দিতে না পারায় এক পিঠা বিক্রেতাকে মারধর করেছে বাড়িওয়ালা ও তার ভাতিজা। একই ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর পান্থপথেও। পরে অবশ্য ওই বাড়িওয়ালী শম্পাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এগুলো মাত্র কয়েকটি ঘটনা।
শুধু ঢাকা শহরে নয়, দেশের বড় বড় শহরে এই ঘটনা ঘটছে। এছাড়া সব খবরতো আর সংবাদ মাধ্যমে আসে না, তাই যতটুকু জানা যাচ্ছে তার চেয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এর বিপরীত চিত্রও যে নেই তা নয়, অনেক বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন, কেউ বাড়ি ভাড়া কমিয়েছেন, কেউবা বলেছেন,যখন পারবেন তখন দেবেন। আবার তেজগাঁওয়ে অনেক বাড়িওয়ালা মিলে করোনায় নানা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগের সাদারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দুই পক্ষকে ধৈর্যধারণ ও সহনশীল হতে পরামর্শ দিয়েছেন। ছাত্রলীগ বলছে, কোনো সমস্যা হলে সমাধানে তাদের ডাকতে।
এখন কথা হচ্ছে, কেন এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, সবাই জানেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতিতে একটা নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছে। লাখ লাখ লোক অপ্রস্তুত অবস্থায় বেকার হয়েছেন। যারই পরিণতি শহর থেকে গ্রাম ফিরে যাওয়া। কিন্তু যাদের ন্যূনতম সঞ্চয়টুকু নেই, তারা কী করবে? তারা খেতেই পারছে না, আর বাড়িভাড়া দিয়ে ঢাকা শহরে থাকাতো দূর অস্ত।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, ঢাকায় বাড়ির সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৪০ হাজার। ঢাকা উত্তরে বাড়ির সংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজার। দক্ষিণে বাড়ির সংখ্যা এক লাখ ৫০ হাজার। তবে ঢাকা দক্ষিণের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হওয়া পাঁচটি ইউনিয়নে আরও প্রায় ৭০ হাজার বাড়ি রয়েছে, যা এখনও সিটি করপোরেশনের আয়করের মধ্যে আসেনি।
Advertisement
করোনায় ভাড়াটিয়ারা যে সংকটে পড়েছেন বাড়িওয়ালারা যে সংকটে পড়েননি তা নয়। কিন্তু বাড়িওয়ালারা এখন না খেয়ে থাকার মতো পরিস্থিতিতে নেই। ভাড়া না পেলে তিনি না খেয়ে মারা যাবেন, এমনটি নয়। যেটি একজন ভাড়াটিয়ার ক্ষেত্রে হয়ে থাকতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। এই সময়ে যাদের কাজ নেই. যারা খেতেই পাচ্ছেন না ঠিকমতো তারা বাড়িভাড়া দেবেন কেমন করে। করোনাকালে কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়া পাক কি না পাক, বিপদের সময় কোনো ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। কঠোরভাবে বলতে হবে, করোনাকালে কোনো ভাড়াটিয়াকে বের করে দেয়া যাবে না।
ঘর থেকে একটা মানুষকে সরিয়ে দেয়াতো অমানবিকতা। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সামাজিক ও সরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচার করা উচিত বলে মনে করি। কারণ বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগ ডেকে বা এলাকাবাসী মিলে এটির সমাধান হবে বলে মনে হয় না। আরও একটা কাজ করা যেতে পারে, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় জরুরি ভিত্তিতে এককালীন হলেও অন্তত দু-তিন মাসের জন্য আর্থিক বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে দরিদ্র মানুষগুলোকে।
আবার বাড়িওয়ালাদের পক্ষেও যুক্তি আছে, সবাই যে বলছেন, বাড়িওয়ালার দোষ, ভাড়া কমান, মওকুফ করে দেন। কিন্তু সরকার কি বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, হোল্ডিং ট্যাক্স, জমির খাজনা কোনটা মওকুফ করেছে। বা ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম কমায়নি। ব্যাংকগুলো সুদ নেয়া বন্ধ করেনি। এসব সমস্যার দিকেও সরকারের মনযোগ দিতে হবে। কারণ বাড়িওয়ালাদের যুক্তিও ঠিক। শহরগুলোতে এমন অনেক বাড়িওয়ালা রয়েছেন যাদের জীবন চলে ভাড়ার টাকায়।
হয়তো সারাজীবনের সঞ্চয় আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটি বাড়ি বানিয়েছেন, তার থেকে ভাড়া নিয়ে ঋণ শোধ করে জীবন চলছে। তাদের দিকটাও ভাবতে হবে। কিন্তু কোনো সমস্যা সমাধানেই স্থায়ী কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। নাগরিক সব সমস্যা সমাধানে যেন একটা লেজেগোবরে অবস্থা। এদিকে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, দেশে এক লাখ ৩৬ হাজার বাড়িওয়ালা সরকারকে কোনো কর দেন না।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাড়িওয়ালাদের বলা হয়, জমিদার। এটা ব্যঙ্গ করে নয়, আক্ষরিক অর্থে। এখন এই বাড়িওয়ালা তথা জমিদারদের মনে রাখতে হবে, যে হারে মানুষ শহর ছাড়ছে এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে সামনে ভাড়াটিয়া খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। ভাড়াটিয়ারা না হয়, গ্রামে গিয়ে নিজের আশ্রয় খুঁজে নেবে। কিন্তু ঢাকা শহরে এত বড় দালানে বাড়িওয়ালা একলা কাকে নিয়ে থাকবেন। ভাড়া না পেলে ঋণ শোধ করবেন কীভাবে, দিন চলবে কেমন করে। তাই সাবেকি জমিদারদের সেই ভাবটা ছেড়ে মানবিক মানুষ হওয়ার, মানবিক বাড়িওয়ালা হওয়ার এইতো সময়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
এইচআর/বিএ/এমএস