ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় হাত বাড়ালেই মেলে মাদক। সীমান্তের কাঁটাতার ভেদ করে আসা এসব মাদকদ্রব্য চলে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। মূলত জেলার বিজয়নগর, আখাউড়া ও কসবা উপজেলার সীমান্ত দিয়েই ভারত থেকে মাদক ঢোকে প্রতিনিয়ত। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের এই মহাদুর্যোগেও থেমে নেই মাদক কারবারিরা। প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও মাদক উদ্ধার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
Advertisement
মাদক উদ্ধারের প্রতিটি ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের হলেও সাক্ষীরা যথাসময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় এবং সাক্ষ্য না দেয়ায় দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে মামলার বিচার কাজ। অনেক মামলা আবার সাক্ষীর অভাবে নিষ্পত্তিও হয়ে যায়। এছাড়া মাদক উদ্ধার অভিযানে গিয়ে ‘মাদক গায়েব’ করার অভিযোগও থাকে অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। সবকিছু মিলিয়ে মাদক উদ্ধার ও মামলার সাক্ষী নিয়ে উভয় সংকটে পড়তে হয় পুলিশ সদস্যদের।
তবে এবার মাদক উদ্ধার অভিযানে স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি সাক্ষীদের সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে দেশে প্রথমবারের মতো ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ। উদ্ধার অভিযান নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে এবং সাক্ষীরা যেন আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পিছু না হটেন সেজন্য ঘটনাস্থল থেকেই উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের ভিডিওচিত্র ও সাক্ষীদের ছবি তুলছে পুলিশ। এর ফলে ঘটনাস্থলে ছিলেন না বা মাদক উদ্ধার সম্পর্কে কিছুই জানেন না এমন কথা আর বলতে পারবেন না সাক্ষীরা। সবকিছু ঠিক থাকলে জুলাই মাস থেকেই জেলার ৯ থানায় দায়ের হওয়া মাদক মামলার নথিপত্রের সঙ্গে ভিডিওচিত্র ও ছবি আদালতে জমা দেবে পুলিশ।
গত ৮ জুন দুপুরে জেলার বিজয়নগর উপজেলার পূর্বভাগ থেকে যাত্রী বেশে অটোরিকশায় ওঠেন এমদাদুল হক (২০) নামে এক তরুণ। তার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে। অটোরিকশাটি কিছুদূর যাওয়ার পরই থামার সংকেত দেয় পুলিশ। এরপর শুরু হয় যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি। এ সময় এমদাদুলের হাতে থাকা একটি ব্যাগ থেকে জব্দ করা হয় সাড়ে ছয় কেজি গাঁজা।
Advertisement
এ ঘটনায় বিজয়নগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. হাসান খলিল উল্লাহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় অটোরিকশা চালক জনি মিয়াকে। ঘটনাস্থল থেকেই কাগজপত্রে জনির স্বাক্ষর নেয় পুলিশ। স্বাক্ষর দেয়ার ছবিও ধারণ করা হয় পুলিশের সদস্যদের মোবাইল ফোনে। স্বাক্ষর নেয়ার ছবি তুলতে দেখে প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করার বিষয়টি জানতে পেরে ভয় কেটে যায় তার।
জনি মিয়া বলেন, ওই তরুণ পূর্বভাগ থেকে পাইকপাড়া যাওয়ার জন্য আমার অটোরিকশায় ওঠেন। পথিমধ্যে জালালপুর আসার পর পুলিশ আমাকে থামার সংকেত দেয়। এরপর তল্লাশি করে এমদাদুলের ব্যাগ থেকে গাঁজা উদ্ধার করে। এরপর পুলিশ আমাকে বলে, মাদক যে উদ্ধার করতে দেখেছি সেটির সাক্ষী হতে। আমি সাক্ষী দিতে রাজি হওয়ার পর কাগজে আমার স্বাক্ষর নিয়ে ছবি তোলা হয়। ছবি তোলার বিষয়টি আমার কাছে ভালোই লেগেছে। আমিও চাই মাদক কারবারিদের শাস্তি হোক। সেজন্য আমি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেব।
১৪ জুন বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল এলাকা থেকে ২৪ কেজি গাঁজা উদ্ধার মামলার সাক্ষী মো. মামুন জানান, সিঙ্গারবিল বাজারের সামনে থেকে গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ। দৌঁড়ে গিয়ে মাদক কারবারিদের আটক করা হয়। আমি এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। পুলিশ আমাকে ও সিঙ্গরবিল বাজারের পাহারাদারকে সাক্ষী হতে বলার পর আমরা সাক্ষী দিতে রাজি হই। এরপর কাগজে আমাদের স্বাক্ষর নেয়া হয়। স্বাক্ষর দেয়ার সময় পুলিশ আমাদের ছবিও তোলে।
জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে জেলার ৯ থানায় দায়ের হওয়া ১৭৩টি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ২২৬ জন মাদক কারবারি। ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩৫টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ১৯৬ জনকে। মার্চ মাসে দায়ের হয়েছে ১১৯টি মামলা, এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ১৭৩ জন। এপ্রিল মাসে ৬১টি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১০৯ জনকে। এছাড়া মে মাসে দায়ের হওয়া ১৩৬টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ১৯১ জনকে।
Advertisement
মাদক উদ্ধার অভিযান নিয়ে বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ সদস্যদের। এছাড়া সাক্ষী নিয়েও দুশ্চিন্তা থাকে। এসবের স্থায়ী সমাধান খুঁজতে উদ্যোগী হয় জেলা পুলিশ। সমাধান হিসেবে মাস দুয়েক ধরে উদ্ধার অভিযানের ঘটনাস্থলের ভিডিওচিত্র ধারণের পাশাপাশি ঘটনাস্থল থেকে সাক্ষীদের ছবি তোলা হচ্ছে। মামলার নথিপত্রের সঙ্গে এসব ভিডিওচিত্র ও ছবি পাঠানো হচ্ছে জেলার পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের কাছে। এখনও পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভিডিওচিত্র ও ছবির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি জুলাই মাস থেকেই আদালতে মামলার নথিপত্রের সঙ্গে ভডিওচিত্র ও ছবি জমা দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতিকুর রহমান বলেন, আদালত থেকে সাক্ষীদের হাজির হতে বলা হলে অনেক সাক্ষীই হাজির হন না। আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সাক্ষী আদালতে গিয়ে ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানান। এতে করে মাদক করাবারিরা পার পেয়ে যায়। এছাড়া মাদক উদ্ধার অভিযান নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সেজন্য আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ঘটনাস্থল থেকে ভিডিওচিত্র ও সাক্ষীদের ছবি তুলে রাখা হচ্ছে। এ উদ্যোগটি মাদক মামলার বিচার কাজে যেমন সহায়ক হবে, তেমনি উদ্ধার অভিযানেও স্বচ্ছতা আনবে।
সাক্ষীদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও আইনজীবীদের কাছেও পুলিশের এই ভিন্নধর্মী উদ্যোগকে কার্যকরী বলে মনে হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে অনীহার কারণে মামালাগুলো হালকা হয়ে যায়। এতে করে বিচার কাজও ঝুলে থাকে। তবে পুলিশ এখন যে উদ্যোগটি নিয়েছে সেটি যদি কার্যকর করা হয় তাহলে সাক্ষীদের নিয়ে যে জটিলতা থাকে, সেটি নিরসন হবে। এছাড়া মাদক উদ্ধার নিয়েও আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না বলে মনে করি।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর দফতর) আবু সাঈদ বলেন, আমরা যে মাদক উদ্ধার করি এটা নিয়ে অনেক সময় কথা ওঠে। এই জায়গাটাতে স্বচ্ছতা আনার জন্যই মূলত আমাদের এই ভিডিওচিত্র ও ছবি তোলার উদ্যোগ। এছাড়া অনেক সাক্ষী আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য না দেয়ায় মামলার বিচার কাজ ঝুলে থাকে। আমাদের উদ্যোগটি পুরোপুরি কার্যকর হলে সাক্ষীরা আর সাক্ষ্য দিতে অনীহা জানাতে পারবেন না। এখন পর্যন্ত আমাদের এই উদ্যোগটি কার্যকর এবং ফলপ্রসু হবে বলেই মনে হচ্ছে।
এফএ/এমকেএইচ