চলতি শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙন ঠেকাতে কয়েক মাস আগে দেয়া ৩৫/১ পোল্ডারের নাজুক বেড়িবাঁধ তেমন কাজে আসছে না। ২০১১ সাল থেকে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বিভিন্ন পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরুর পর গত ৫ বছরে সুন্দরবন সংলগ্ন বগী বন্দর, তেরাবেকা, শরণখোলা, সোনাতলা, পানিরঘাট ও ডালির ঘোপ এলাকার ভাঙনের তীব্রতা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ভাঙন কবলিত ওই এলাকার মধ্যে সব চেয়ে খারাপ অবস্থা মুক্তিযোদ্ধা অধ্যুষিত বগী গ্রাম। বর্তমানে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে নদী ভাঙনের কারণে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। নিরুপায় হয়ে অনেকে তাদের সহায় সম্বল বাঁচাতে সরিয়ে নিচ্ছে বসত ঘরের আসবাবপত্র। আবার অনেকেই পানির দরে বিক্রি করছেন বসতবাড়িগুলোর গাছপালা। বলেশ্বর নদীর ভাঙন থেকে বন সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী বগী বন্দরকে রক্ষার জন্য ১৯৬১ সালে সর্বপ্রথম বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেন তৎকালীন সরকার। তখনকার সময় ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে স্থানীয় পঞ্চায়েত বাড়ির দূরত্ব ছিল ৩ কিলোমিটারের বেশি। ওই সময় ঢাকার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল বগী বন্দরটি এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৯ নং সেক্টরের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের তখনকার সময় ওই বাজারটিই ছিল মূল ঘাটি। ওই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা শরণখোলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শত্রু মোকাবিলায় নানা পরিকল্পনার ছক তৈরিসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের খাবার ও বিভিন্ন রসদ খুব সহজেই গভীর জঙ্গলে পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী ব্যক্তিরা। কিন্তু হঠাৎ করে ১৯৮০ দশকে বলেশ্বর নদীর ভাঙন শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫ বার বেড়িবাধ বিলীন হয়ে বহু বাড়িঘর, মসজিদ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ সহস্রাধিক ফসলি জমি বলেশ্বরের গর্ভে চলে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে শতশত পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধের উভয় পার্শ্বে। এছাড়া সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বগী স্টেশন ভাঙনের তীব্রতায় ৪/৫ বার স্থানান্তর করতে হয়েছে। বন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা শেখ মোহম্মদ গাউস ফারুকী, রুস্তুম হাওলাদার, মোজাম্মেল হোসেন, আলো মুন্সী, বারেক পঞ্চায়েত, হেমায়েত পঞ্চায়েত ও কামাল পঞ্চায়েতসহ বগী এলাকার একাধিক বাসিন্দারা বলেন, বগী এলাকার এক সময়ের ছোট নদী এখন চরম খরস্রোতা নদীতে পরিণত হয়েছে। বেড়িবাঁধে গত ৩০/৩৫ বছরে ৪/৫ দফা ভাঙনের ফলে ওই এলাকার অর্ধ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু পরিবার তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেছে। কোনো উপায় না পেয়ে কেউ কেউ আবার পরিবার পরিজন নিয়ে সরকারি বিভিন্ন খাস জমি ও বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়ে এক প্রকার মানবেতর জীবন যাপন করছে। মুক্তিযোদ্ধা গাউস ফারুকী আরো বলেন, বলেশ্বর নদীতে বিলীনের পথে বসতভিটার সঙ্গে তার জীবনের বহু স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও ভাঙনের তীব্রতার কারণে ঘরের মালপত্র নিয়ে অনত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। শত চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেনি তার পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া শেষ চিহ্ন। তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তে একটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই চান সরকারের কাছে। এ বিষয় সাউথখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, বর্ষা ও শুষ্ক উভয় মৌসুমে বলেশ্বর নদীর ভাঙন অব্যাহত থাকায় তার ইউনিয়নের মানচিত্র ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। যে কারণে দিন দিন গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এদের পুর্নবাসন করতে না পারলে গৃহহীনদের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, বনের মধ্য থেকে জাহাজ চলাচল ছাড়াও বলেশ্বর নদীর বিভিন্ন স্থানে চর জেগে ওঠায় পানির স্রোত লোকালয়ের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া শীত মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ভাঙন বর্ষা মৌসুমের চেয়েও তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মশিউর রহমান বলেন, যেহেতু কিছু কিছু এলাকা মূল বেড়িবাঁধের বাইরে তাই আপাতত (পাউবোর) কিছুই করার নেই। তারপরও ক্ষতিগ্রস্তরা যথাযথভাবে আবেদন করলে বিষয়টি মানবিক হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।শওকত আলী বাবু/এসএস/এমএস
Advertisement