বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
Advertisement
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/নদেয় এলো বান’- এমন টাপুর টুপুর ছন্দ তোলা ভরা বর্ষায় বাংলাদেশে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, পুকুর নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া সুরের তরঙ্গ খেলায় মেতে ওঠে নতুন জলরাশি। মাঠের পাশ দিয়ে কল কল শব্দে বয়ে চলা ছোট্ট খাল, বাড়ির আশেপাশের পুকুরে নতুন টলমলে জলের মাঝে চোখ জুড়ানো সবুজ হেলেঞ্চা-কলমি মাথা তুলে দাঁড়ায়। এদের ডালের ফাঁকে ফাঁকে লালচে-সোনালি ডোরাকাটা দেহাবরণের টাকি মাছের পোনার দল বিশ্রাম নেয়। পোনাদের পিঠে ঝলমলে আলোর প্রতিফলন। আর তাতেই চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে। আশেপাশেই মা অথবা বাবা টাকি মাছ জলের উপরিভাগে ভেসে বুদবুদ তোলায় ব্যস্ত। যাতে পোনাগুলো ঠিকমতো অক্সিজেনের প্রবাহ পায়।
বর্ষা বা প্রাক-বর্ষা হলো টাকি মাছের প্রজননকাল। এ সময় এরা পুকুর বা খালের পাড়ের কাছে এক থেকে দেড় মিটার গভীরে বাসা তৈরি করে। এরা সাধারণত জলজ উদ্ভিদের লতা-পাতা দিয়ে বাসা তৈরি করে এবং সেখানে স্ত্রী-মাছ ডিম ছাড়ে। এরপর পুরুষ মাছ ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে স্ত্রী-পুরুষ মাছ বাচ্চাগুলোকে পাহারা দেয়। পোনাগুলো ঝাঁক বেঁধে পানিতে চলে। এমন সময় স্ত্রী-পুরুষ মাছ এই ঝাঁকের বাইরে চারদিকে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেয়।
আমাদের শৈশবের সাথে টাকি মাছের পোনা বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে। টাকি মাছের পোনার ঝাঁক আমাদের শিশুতোষ মনে অন্যরকম পাগলাটে আনন্দের ঢেউ তুলত। বাঁশের তৈরি চালুনি, পাতলা কাপড় বা গামছা দিয়ে টাকি মাছের পোনার ঝাঁক আমরা অনেকেই ধরেছি এবং বাড়িতে এনে মা, নানি, দাদিকে দিয়েছি। তারা মরিচ-পেঁয়াজ কুচি, হলুদ-মরিচের গুঁড়ো ও মোটা দানার লবণ দিয়ে মাখিয়ে পোনাগুলোকে সরিষা তেলে ভেজে দিয়েছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে। আহ! অমৃতসম সে স্বাদ!
Advertisement
শিশুতোষ মন না বুঝেই তখন পোনাগুলোকে ধরে এভাবে অমৃতের স্বাদ নিয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে অন্যান্য অনেক দেশীয় মাছের মতো টাকি মাছ বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্তের খাতায় নাম লেখায়নি। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ বা আইইউসিএনের লাল তালিকা অনুযায়ী, প্রজাতিটি বাংলাদেশে এখনো হুমকির সম্মুখীন নয়। ফলে মাছের বাজারে এখনো টাকি মাছ বহাল তবিয়তেই ওঠে।
পৃথিবীর নানা দেশে টাকি মাছ পাওয়া গেলেও কিন্তু এ উপমহাদেশেই এর উৎপত্তি। গবেষকদের ধারণা, ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ হিমালয় অঞ্চলে (বর্তমান ভারতের উত্তরাঞ্চল ও পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল) অন্তত ৫ কোটি বছর আগে টাকি মাছের উৎপত্তি হয়।
শুধু পোনা নয়, মূলত ভর্তার কারণে টাকি মাছ বাংলা খাদ্য সংস্কৃতিতে বেশ শক্তভাবেই আছে। ভর্তা ও মাছকে যদি কল্পনা করতে হয়, তবে বাঙালির রসনা বিলাসের অনেকখানি জুড়েই আছে টাকি মাছের ভর্তা। এ উপমহাদেশে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে টাকি মাছের পোনা ভাজি ও মাছ ভর্তা বা ভাজি খাদ্য সংস্কৃতির অংশ।
লেখক: ফার্মাসিস্ট ও সমাজকর্মী।
Advertisement
এসইউ/এএ/পিআর