রানা আহমেদ ৩৬তম বিসিএসের সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে আছেন। বাবা হাজী আব্দুল হক আকন্দ, মা সালেহা বেগম। তিনি ১৯৮৭ সালের ৭ মার্চ নেত্রকোনার দুর্গাপুরের বাগিচাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিরিশিরি পিসিনল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, সুসং সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
Advertisement
সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার—
ছোটবেলা কেমন কেটেছে?রানা আহমেদ: ছোটবেলা ছিল দুরন্তপনায় ভরা। বাড়ির পাশেই এমকেসিএম পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠ। সকাল-সন্ধ্যা সেই মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতাম। দুপুরে ক্ষুধায় শরীর দুর্বল হলেই কেবল বাসায় ফিরতাম। বিকেলে আবার মাঠে। সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতাম অন্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সেসময় অন্য এলাকার ছেলেমেয়েরাও আসতো। আমরা একসাথে গোল্লাছুট, বৌচি, দাঁড়িয়াবান্ধা, বোম্বাস্টিং এবং আরও কত রকমের খেলাধুলা করেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা হয়তো এসব খেলাই চিনবে না। গ্রামের একটি দুরন্ত বাচ্চার, কিশোরের শৈশব ছিল আমার। এসবের জন্য বাড়িতে দৈনিকই বকা খেয়েছি। প্রায়ই আব্বা, আম্মা, ছোট মামার হাতে মার খেয়েছি। তবে সেসব শাসনের জন্যই আজকের আমি।
পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?রানা আহমেদ: পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। আমার আব্বা-আম্মা কেউই স্কুলের গণ্ডি পার হননি। প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত হয়তো পড়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সব ভাই-বোন নিয়ে তাদের চেষ্টা ছিল অফুরান। সেই চেষ্টা ও দোয়ার ফলেই আজ আমার বড়ভাই জার্মানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন পাঁচ বছর আগেই। আমার ছোটভাই আইন বিষয়ে অনার্স শেষ করেছে এ বছর। ছোট বোনও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স শেষ করেছে। প্রতিবন্ধকতা আসলে নিজেই ছিলাম। পড়াশোনার চেয়ে দুরন্তপনাই বেশি করতাম। ছোটবেলায় কুপি বাতি কিংবা হারিকেন দিয়ে পড়েছি। প্রতিবন্ধকতা বলতে এতটুকুই ছিল, কখন কিভাবে পড়তে হবে, কী কী পড়তে হবে—বিষয়গুলো দেখানোর কেউ ছিল না। নিজেরাই নিজেদের মতো গুছিয়ে নিতাম।
Advertisement
বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—রানা আহমেদ: সত্য বলতে, আমি অনার্স শেষ করে বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছি। আব্বা আগে থেকেই বলতেন, বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হতে। আমার ইচ্ছা ছিল জার্নালিজমের প্রতি। নিউজ কালেক্ট করা, বিভিন্ন জায়গায় ছুটে যাওয়া—অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চার। অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর যখন দেখলাম কাছের অনেক বন্ধু-বান্ধব বিসিএসের কোচিং করছে; তখন আমি কিছুটা আলাদা হয়ে গেলাম। ওরা কোচিংয়ে চলে যেত, আবার সন্ধ্যা বা রাতের আড্ডায় বিসিএসের গল্পই চলতো। এসব দেখে আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম কোচিং করার। আব্বাকে জানালে আব্বা সাথে সাথেই রাজি হন। পরদিনই কোচিংয়ে ভর্তির টাকা পাঠিয়ে দেন। ময়মনসিংহের একটি কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে যাই। দু’জন শিক্ষকের ক্লাস খুব ভালো লাগতো। একজন ছিলেন বিজ্ঞানের মাহমুদ ভাই, অন্যজন বাংলার মুসাব্বির ভাই। আমি স্কুল, কলেজে ব্যবসায় শিক্ষায় পড়েছি। বিজ্ঞান ছিল আতঙ্কের নাম। অথচ মাহমুদ ভাইয়ের কাছে সেই বিজ্ঞান হয়ে গেল পছন্দের আরেক নাম।
যা হোক, প্রিলিমিনারি দিলাম। তখনও অনার্সের রেজাল্ট হয়নি। প্রিলিমিনারির প্রায় দুই মাস আগে মনে হলো, পরীক্ষায় না টিকলে বিষয়টি লজ্জাজনক হবে। ডিপার্টমেন্টে স্যার, ম্যাডামরা আমাকে চিনতো ভালোভাবেই। কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সব সময় থাকতাম। ফলে অন্য ডিপার্টমেন্টের অনেক শিক্ষক আমাকে চিনতেন। ভাবলাম, প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় না টিকলে আমার কাছের মানুষগুলো কষ্ট পাবে। তারপর দুই মাস প্রতিদিন ১২-১৪ ঘণ্টা পড়েছি। প্রথমবারই টিকে গেলাম। রিটেনের সময়ও খুব সিরিয়াস হয়ে গেলাম। বেশ ভালো রিটেন দিলাম। এবার ভাইবার পালা। জীবনের প্রথম ভাইবা ছিল। কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। তখন নন-ক্যাডার পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে পূবালী ব্যাংকে অফিসার (জেনারেল) হিসেবে জয়েন করি সে বছরই। ব্যাংকে চাকরিরত অবস্থায় ৩৪ ও ৩৫তম বিসিএসের ভাইবা দেই। সেগুলোতেও নন-ক্যাডার। কিছুটা ভুল ছিল আমার। আসলে বুঝিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। প্রফেশনাল ক্যাডার কখনোই চয়েজে রাখিনি। ৩-৪টি ক্যাডার থাকতো। ফরেন, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পুলিশ ও ট্যাক্স। ফলে ভাইবাগুলো কঠিন হয়ে যেত।
৩৬তম বিসিএসে ক্যাডার চয়েজ বদলে দিলাম। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পুলিশ, শিক্ষা। এ ৩টি ক্যাডার তালিকায় রাখলাম। রিটেনের আগে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে চলে এলাম কিছুটা রিস্ক নিয়ে। তখন চাকরিতে আবেদনের বয়স ৮ মাস বাকি। প্রায় দুই মাস সময় পেয়েছিলাম রিটেনের জন্য। বাড়িতে এসে ১০ দিন ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি করলাম, আনন্দ করলাম। তারপর ঢাকায় চলে গেলাম ছোট ভাই-বোনের সাথে। দেড় মাস দিন-রাত পড়াশোনা করলাম। বিজ্ঞান, গণিত পরীক্ষা খুব বাজে হলো। অন্যসব বেশ ভালো।
সে সময়ই ৩৪ বিসিএসের নন-ক্যাডার থেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে হাইস্কুলে চাকরি পেয়ে যাই। আবার ৩৭তম বিসিএসের প্রিলিতেও টিকে যাই। ওটা ছিল আমার শেষ বিসিএস। অংশগ্রহণ করা ৫টি বিসিএসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো রিটেন দিয়েছিলাম ৩৭তমে। ৩৬তম বিসিএসের রিটেনের ৫ মাস পরই ৩৭তমের রিটেন দেই। ফলে পড়াশোনা করেছিলাম খুব বেশি। ৩৬তমের ভাইবা দিয়েছিলাম চমৎকার। ভাইবা শেষ করেই মনে হলো শিক্ষা ক্যাডার পেয়ে যাব। কারণ বিজ্ঞান আর গণিত ভালো হয়নি আমার।
Advertisement
ততদিনে আমার বাসার পাশেই দুর্গাপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার পোস্টিং হলো। ৩৬তমের রেজাল্ট হলো। আমি শিক্ষা ক্যাডার পেয়ে গেলাম। আগের বছর ক্যাডার পেয়ে আবার ভাইবা, ক্যাডার চেঞ্জ—এসব বলে ৩৭তমের ভাইবা নেয়নি বোর্ড। কিছুটা তর্কও করেছিলাম সেজন্য। তারপর বসিয়ে কিছু আলাপ করেছিলেন স্যার। ৫ মিনিট আলাপ করার পর তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার মতো শিক্ষক দরকার আমাদের।’ আমার বিসিএস যাত্রা তখন সমাপ্ত হলো। শিক্ষা ক্যাডারে জয়েন করি নেত্রকোনা সরকারি কলেজে।
কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?রানা আহমেদ: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের অনুপ্রেরণা পেয়েছি। জীবনে দেখিনি, এমন মানুষের কাছ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছি তাদের গল্প শুনে। তবে সবচেয়ে বেশি পেয়েছি আব্বার কাছ থেকে। আব্বা সব সময় সাহস দিতেন। প্রথম বিসিএসের সময় যখন ক্যাডার পাইনি; তখন আব্বা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে সাহস দিয়েছিলেন অনেক। পরের বিসিএসে রিটেনের আগেই আব্বা মারা গেলেন। আব্বা চলে যাওয়ার ১২ দিন পরই ব্যাংকের চাকরি পেয়েছিলাম। ওটা ছিল চাকরির জন্য আমার ২য় ভাইবা। ৩৩তম বিসিএসের ভাইবা ছিল প্রথম। আমি চাকরি পাওয়ার খবর শুনে খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। কারণ আব্বা দেখে যেতে পারেননি।
অনুপ্রেরণার জন্য আব্বার পর বলবো আমার দাদাভাইয়ের কথা। ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত আমার অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় জায়গা দাদাভাই। কখনোই দাদাভাইকে এটা বলা হয়নি। এ ছাড়া আমার আম্মাসহ পরিবারের বাইরে আরেকজন আমাকে খুব সাহস দিতেন। তিনি আমাদের দুর্গাপুর কলেজের শিক্ষক, আমার কাছের বড় ভাই শফিউল আলম স্বপন। আমার বিসিএস যাত্রায় তিনি বেশ সাহস দিয়েছেন। কোচিংয়ের শিক্ষক মাহমুদ ভাই এক ভালোবাসার নাম। ভাইয়া সব সময় সাহস দিয়েছেন। কাছের বন্ধু-বান্ধবরাও সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তবে নিজেই নিজেকে অনুপ্রেরণা দিতে হয়। আমি বারবার পিছলে পড়েছি, থেমে যাইনি। নিজেকে নিজেই অনুপ্রেরণা দিতাম।
একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?রানা আহমেদ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে। তবে পরিকল্পনার সাথে সব কিছুর হিসেব মেলে না আমাদের। সিনেমা বানানোর প্রতি খুব ঝোঁক ছিল অনেক বছর আগে থেকেই। লেখালেখির অভ্যাস ছিল একসময়। এগুলো খুব মিস করি। পিএইচডি করাটা এখন মূল পরিকল্পনা। আল্লাহ যদি চায়, তাহলে পিএইচডি করতে চাই। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মনের মধ্যে থাকতে চাই। আমার মৃত্যুর পরও যেন ছাত্রছাত্রীরা আমার গল্প করে অন্যের সাথে। কোনদিন হয়তো একটি সিনেমা বানাবো। অন্তত শর্ট ফিল্ম। কিছু লেখালেখিও করবো। তাছাড়া কিছু মানবিক, সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত আছি। সেগুলোর জন্য কাজ করতে চাই। ট্রাভেল নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আছে। বৃদ্ধ ও পথশিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা আছে। মানুষের মুখের হাসি দেখার যে আনন্দ, তা আর কিছুতেই হয় না।
সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী? রানা আহমেদ: আমার আশেপাশের মানুষদের সাধ্যমতো সচেতন করি। ফেসবুকেও আমার ছাত্রছাত্রীদের এ বিষয়ে বলি। তাদের অনেকের খোঁজ-খবর নেই। তারাও খোঁজ নেয় ফোন করে। কলেজ বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছি এখন। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীদের সাহস দিচ্ছি, অনুপ্রেরণা দিচ্ছি পড়াশোনার জন্য।
এসইউ/এমএস