তাকে বলা হয় ঢাকাই ছবির ক্রান্তিলগ্নের ক্যাপ্টেন হিরো। সেই ডিপজল-মান্নার অশ্লীল যুগে যখন ডুবতে বসেছিলো চলচ্চিত্র শিল্পের মান তখন রিয়াজ হাল ধরেছিলেন একাই। তিনিই মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত শ্রেণির দর্শকদের হলে ধরে রেখেছিলেন শাবনূর-পূর্ণিমার সাথে জুটি বেঁধে। উপহার দিয়েছিলেন শ্বশুড়বাড়ি জিন্দাবাদ, দুই দুয়ারী, জামাই শ্বশুড়, প্রেমের তাজমহল, পাগল তোর জন্য, সুন্দরী বধু, মনের মাঝে তুমি, দারুচিনি দ্বীপ, হৃদয়ের কথা, মোল্লা বাড়ির বউয়ের মতো ব্যবসা সফল এবং আলোচিত চলচ্চিত্র। আজ প্রিয় এই অভিনেতার জন্মদিন। প্রতিবারের ন্যায় এবারেও পরিবার, কাছের মানুষজন আর ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে উঠেছে নায়কের বিশেষ এই দিনটি। তবে অন্যান্যবারের মতো প্রাণ নেই। কারণ, অসুস্থ রিয়াজ। গেল ১৯ অক্টোবর মেহের আফরোজ শাওন পরিচালিত ‘কৃষ্ণপক্ষ’ চলচ্চিত্রের শুটিং স্পটে রিয়াজের হার্ট অ্যাটাক হয়। সেখান থেকে তাকে প্রথমে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে এবং পরে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসায় রিয়াজের হার্টে চারটি ব্লক ধরা পড়ে। যার একটিতে রিং পড়ানো হয়েছে। এখন তার অবস্থা বেশ ভালো। তবে যে কোনো ধরনের শংকা এড়াতে রিয়াজকে ছয় মাসের পূর্ণ বিশ্রাম দিয়েছেন অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদার।বাসায় ফিরলেও ডাক্তারের পরামর্শে পরিবারের সব সদস্যের নজরদারিতে আছেন তিনি। তাই ঘটা করে পালন করা হচ্ছে না তার এবারের জন্মদিন। এ নিয়ে তার স্ত্রী টিনা জাগো নিউজকে জানান, ‘ইচ্ছে থাকলেও এবারে রিয়াজের জন্মদিনে তেমন বিশেষ কিছু আয়োজন করা হবে না। আমাদের দুই জনের পরিবার থেকে কিছু আত্মীয়রা আসবেন। ফিল্মের কিছু কাছের মানুষরা আসবেন। মূলত সবাই ওকে দেখতেই আসবেন। এর ফাঁকেই ওর সাথে গল্প-গুজব করে জন্মদিনটা পালন করা হবে। আর ওর জীবনে এটা বিশেষ জন্মদিন। কারণ, এবারে সে বাবা রিয়াজ। এ নিয়ে ভিষণ উত্তেজিত সে। সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়ে মেতে আছে। হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ওর এই আনন্দ দেখেই আমার ভালো লাগছে।’তিনা আরো বলেন, ‘এই দিনে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই তার ভক্ত, সহকর্মী এবং আত্মীয়স্বজনকে। তাদের দোয়ায় এবং সৃষ্টিকর্তার রহমতে রিয়াজ সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে।’টিনা আরও জানান, অ্যাপোলো হাসপাতালের ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক রিয়াজের সুস্থতার বিষয়ে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।এক নজরে রিয়াজরিয়াজের পুরো নাম রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। জন্ম ১৯৭২ সালের ২৬ অক্টোবর ফরিদপুর জেলা সদরের কমলাপুর মহল্লায় একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বেড়ে উঠেছেন ফরিদপুর সিএনবি স্টাফ কুয়ার্টার্সে। বাবা মৃত জাইনুদ্দিন আহমেদ সিদ্দিক একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন ও মাতা আরজুমান আরা বেগম একজন সু-গৃহিণী। রিয়াজের বড় ছয় বোন, জিন্ন্যা আরা, সুলতানা জাহানারা সিদ্দিক, সুলতানা রওনক আরা, সুলতানা রওশন জামিল, সুলতানা সালমা শাহীন ও সুলতানা ফাতেমা শিরিন। পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান রিয়াজ আহমেদ ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর ২০০৪-এর বিনোদন বিচিত্রার ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হিসেবে নির্বাচিত মডেল মুশফিকা তিনা’র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।রিয়াজ ১৯৭৭-এ ফরিদপুর জেলা সদরে অবস্থিত তারার মেলা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে আমার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখানে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে ফরিদপুর সদরে অবস্থিত মহিউদ্দিন হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে এসএসসি পাশ করেন।এরপর ফরিদপুর থেকে চলে যান পৈতৃক বাসস্থান যশোর জেলায়। যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে এইচএসসিতে ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয় কলেজ জীবন। এইচএসসি পাশ করার পর বুয়েটে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকা এসে কোচিং শুরু করেন। কিন্তু পরিবারের বড়দের উৎসাহে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স একাডেমীতে ১৯৯১ সালের জুন পর্যন্ত অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরইমধ্যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএসসি ডিগ্রি নেন। ১৯৯১ সালে তুর্কি সরকারের দেয়া একটি বৃত্তিতে টি থাই সেভেন এয়ার ক্রাফটের উপরে একটা প্রশিক্ষণ নিতে ক্যাডেট হিসেবে তুরস্ক যান। ঐ প্রশিক্ষনটিতে খুবই ভাল ফল অর্জন করেন রিয়াজ। এর পুরস্কার হিসেবে তাকে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রদান করে তুর্কি সরকার। কিন্তু বিভিন্ন রকমের প্রক্রিয়াকরণ এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গড়িমসির কারণে প্রশিক্ষণটি নেয়া সম্ভব হয়নি।পরে বাংলাদেশে ফিরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে একজন বিমান চালক হিসেবে নিয়োগ পান। কর্মরত থাকাকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি জেট ফাইটার বিমানে মোট ৩০০ ঘন্টা ওড়ার গৌরব অর্জন করেন এই নায়ক। পরে কর্তৃপক্ষের সাথে ভুল বোঝাবুঝির কারনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী থেকে বেরিয়ে আসেন। শুরু হয় নতুন উত্থানের গল্প। বিধাতা যাকে কোটি মানুষের ভালোবাসায় সম্মানিত করবেন কেন তিনি পড়ে রইবেন শাসন-কানুনের কয়েদখানায়! রিয়াজ চাচাত বোন চিত্রনায়িকা ববিতার সাথে বেড়াতে আসেন এফডিসিতে। সেখানে এসে নজরে পড়েন প্রয়াত চিত্রনায়ক জসীমের। এবং তার ইচ্ছেতেই বাংলার নায়ক ছবি দিয়ে ১৯৯৫ সালে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হলো আজকের জনপ্রিয় অভিনেতা রিয়াজের।এ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’র মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন রিয়াজ। দুটি ছবিতে করেছেন বিশেষ চরিত্রে অভিনয়। তার জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অজান্তে, হৃদয়ের আয়না, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, তুমি শুধু তুমি, ভালোবাসি তোমাকে, এ জীবন তোমার আমার, বুক ভরা ভালোবাসা, পৃথিবী তোমার আমার, বিদ্রোহ চারিদিকে, কাজের মেয়ে, স্বপ্নের পুরুষ, আশা আমার আশা, বিয়ের ফুল, তোমার জন্য পাগল, নারীর মন, আমি তোমারই, এ বাঁধন যাবেনা ছিঁড়ে, সাবধান, ভয়ংকর বিষু, হৃদয়ের বন্ধন, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, মিলন হবে কত দিনে, প্রেমের তাজমহল, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, অন্তরে ঝড়, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, মনের ঝামে তুমি, গুণ্ডার প্রেম, ভালোবাসা কারে কয়, মাটির ফুল, জামাই শ্বশুর, স্বপ্নের ভালোবাসা, রঙ নাম্বার, না বোলনা, টাকা, মোল্লা বাড়ির বউ, হৃদয়ের কথা, সাথী তুমি কার, তোমাকেই খুঁজছি, ছোট্ট একটু ভালোবাসা, আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা, বাঁধা, নষ্ট, জমিদার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।এছাড়া রিয়াজ অভিনীত দুই দুয়ারী, মেঘের পরে মেঘ, শাস্তি, কি জাদু করিলা, কুসুম কুসুম প্রেম, এবাদত, চন্দ্রগ্রহণ, মেঘের কোলে রোদ, দারুচিনি দ্বীপ, খেলাঘর, হাজার বছর ধরে, শ্যামল ছায়া ছবি গুলো ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে দেশে-বিদেশে। তিনি এস এ হক অলিকের পরিচালনায় পূর্ণিমার বিপরীতে অভিনয় করা ‘হৃদয়ের কথা’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক ছিলেন। এটিই তার প্রযোজিত প্রথম ছবি। রিয়াজ দুই দুয়ারী, দারুচিনি দ্বীপ, কি জাদু করিলা ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পাশাপাশি প্রাণের চেয়ে প্রিয়, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, প্রেমের তাজমহল, মনের মাঝে তুমি, শাস্তি, হাজার বছর ধরে, হৃদয়ের কথার জন্য মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পান।চলচ্চিত্র ছাড়া নাটকেও রিয়াজের আকাশ চুম্বি জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে রিয়াজ আজো দর্শকের হৃদয়ে পূজনীয় হয়ে আছেন। চলচ্চিত্র ও নাটক এ অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞাপন চিত্রেও কাজ করেছেন। তারমধ্যে ফিজআপ ও ড্যানিশের সিরিজ বিজ্ঞাপনগেুলো অনেক জনপ্রিয়তা পায়। প্রশংসিত হয় নাসির গ্লাসের বিজ্ঞাপনটিও।মাঝখানে প্রায় দুই বছর অভিনয় থেকে বিরতি নিয়ে ব্যবসায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনয়ের মায়ার কাছে হার মেনে তিনি আবারো ফিরে এসেছেন শোবিজে। গেল দুই ঈদে প্রায় সব চ্যানেলেই প্রচার হয়েছে রিয়াজের খন্ড ও ধারাবাহিক নাটক এবং টেলিছবি। জাহিদ হাসান ও মোশাররফ করিমের একঘেয়েমি অভিনয়ের ভিড়ে রিয়াজের সরব উপস্থিতি দর্শকদের ভিন্ন বিনোদন দিয়েছে। রিয়াজ ফিরতে চেয়েছিলেন তার আঁতুর ঘর চলচ্চিত্রেও। শুরু করেছিলেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবির কাজ। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক করার পর খানিকটা আশঙ্কা তৈরি হয়। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন সুস্থ রিয়াজ। ছয় মাস বিশ্রাম নিয়ে আবারো শুরু করতে পারবেন স্বাভাবিক জীবন। আর কৃষ্ণপক্ষের পরিচালক মেহের আফরোজ শাওনও জানিয়েছেন, সব কিছুর আগে রিয়াজের সুস্থতা। তিনি হুমায়ূন আহমেদের খুব প্রিয় অভিনেতা। তিনি বেঁচে থাকলে এবং কৃষ্ণপক্ষ নির্মাণ করলে তাকে দিয়েই মুহিব চরিত্রটা করাতেন। তাই শাওনও চাইছেন রিয়াজ থাকুন। ১৩ নভেম্বর ছবিটি মুক্তি দিতে না পারলেও রিয়াজের সুস্থতার জন্য অপেক্ষা করবেন শাওন। নন্দিত চিত্রনায়ক রিয়াজকে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা এবং ৪৪তম বছরে অভিনন্দন। আরো অনেকদিন তিনি বেঁচে থাকুন ঢাকাই ছবির প্রয়োজনে।এলএ
Advertisement