মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চের শেষের দিকে দেশে জরুরি খাত ছাড়া সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি সেই পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলেও কাজকর্ম খরায় অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকের চাকরি থাকলেও অনিয়মিত হয়ে গেছে বেতন। কর্মের সুবাদে এতদিন ধরে যারা রাজধানীর ভাড়া বাসায় থাকছেন, বেশিরভাগই সময় মতো ভাড়া পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল বাড়িওয়ালারা পড়েছেন বিপাকে।
Advertisement
তারা বলছেন, ভাড়াটিয়া ভাড়া না দিলেও বাড়িওয়ালাদের পরিশোধ করতে হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের ইউটিলিটি বিল। ব্যাংক ঋণেও নেই ছাড়। এর মধ্যে একের পর এক ভাড়াটিয়া চলে যেতে থাকায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে বাড়ির মালিকদের।
রাজধানীর মান্ডায় দেড় কাঠা জমির ওপর ছোট্ট একটি সেমিপাকা বাড়ি করেছেন তাসলিমা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ায় ছয় রুমের ওই বাড়িই তার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ। বাড়ির সামনের দোকান, আর পেছনের রুম ভাড়া দিয়ে চলে সংসার। ৪০ হাজার টাকা ভাড়া পান, তা থেকে প্রতি মাসে গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিলবাবদ ৮-১০ হাজার টাকা চলে যায়। বাড়ি করার সময় বিভিন্ন দোকান থেকে মালামাল বাকিতে কিনেছেন। সেই পাওনা পরিশোধ করতে চলে যায় আরও প্রায় ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতি মাসে রয়েছে বাড়ি সংস্কারের বিভিন্ন খরচ। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে কোনোমতে চলে সংসারের খরচ।
তসলিমা বলেন, ছয় রুমের বাসার তিন রুমের ভাড়াটিয়া গত মার্চ মাসের লকডাউনের সময় গ্রামে চলে গেছেন। বাকি তিন রুমের ভাড়াটিয়া থাকলেও নিয়মিত ভাড়া দিচ্ছেন না। লকডাউনের কারণে দুই মাস বিল বকেয়া হয়েছে। এখন তিন মাসের শুধু বিদ্যুৎ বিল এসেছে ২২ হাজার টাকা। গ্যাস-পানি মিলিয়ে জুনে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু গত তিন মাসে সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকাও ভাড়া পাইনি।
Advertisement
‘পাওনাদারদের ঋণের টাকা দিতে পারছি না বিধায় তারা চাপ দিচ্ছেন। ভাড়াই তো পাই না, টাকা দেব কীভাবে? এখন কোনোমতে ধার-দেনা করে বেঁচে আছি। এভাবে আর কিছুদিন থাকলে বাড়ি বেচে বিল আর ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে।’
এই বাড়িওয়ালা আরও বলেন, সরকার অনেক সহযোগিতা করছে, সেটা গরিব আর বড় লোকের জন্য। মাঝে আমরা পড়ে আছি বিপাকে। জমানো টাকা শেষ, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে চলছি। এভাবে আর কতদিন চলব?
শুধু ছোট বাড়ির মালিকরা নন, বড় বাড়ির মালিকরাও সমস্যায় আছেন। রাজধানীর মুগদা এলাকার একটি বাড়ির মালিক আব্দুস সাত্তার। মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা বাড়ি ভাড়া পান। তবে এর বড় একটি অংশই ইউটিলিটি বিল চলে যায়। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ঋণের কিস্তি।
আব্দুস সাত্তার জাগো নিউজকে জানান, গত মার্চ মাসে তিনটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছিল। লকডাউনের কারণে সেগুলো আর ভাড়া হয়নি। এছাড়া যেসব ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া আছেন তাদের অনেকে দুই-তিন মাস ধরে ভাড়া দিচ্ছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কাউকে ভাড়ার জন্য চাপও দেয়া যাচ্ছে না। কারণ সবাই তো সমস্যায়। এর মধ্যে আগামী মাসে আরও এক ভাড়াটিয়া চলে যাবেন। গত মাসে তিন মাসের বিল পরিশোধ করেছি। প্রায় তিন লাখ টাকা চলে গেছে। দুই মাস ব্যাংক ঋণের কিস্তি দেই না। চলতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকা লোনের কিস্তি হিসাবে দিতে হবে।
Advertisement
‘করোনাভাইরাসের কারণে সমস্যায় আছে সবাই। আমার ভাড়াটিয়ার ইনকাম থাকলেই তো আমাকে ভাড়া দেবে, না থাকলে কীভাবে দেবে? এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। সারাজীবনের আয়, জমি বিক্রির টাকা, আর ব্যাংক ঋণ নিয়ে এই বাড়ি করা। এটাই আয়ের একমাত্র পথ। ভাড়াটিয়া না থাকলে চলব কীভাবে? ব্যাংক কয়দিন আমাকে ছাড় দেবে? তিন মাসের বড় একটা অংকের বিল দিতে হলো। এভাবে আর কতদিন চলবে?’
একই অবস্থা মালিবাগের সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বাড়ির মালিক সালাউদ্দিন হোসেনের। বাড়িতে থাকা পাঁচটি ফ্ল্যাট ও দুটি দোকানের ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এর বাইরে আর কোনো আয় নেই। করোনাকালে ভাড়াটিয়াদের আয় কমে যাওয়ায় পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া কমানোসহ নানা রকম প্রণোদনা দিয়েছেন তিনি। তাতেও থাকছে না ভাড়াটিয়া। জুলাইয়ে মাত্র দুই ভাড়াটিয়া আছে তার বাড়িতে।
সালাউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আমার পাঁচটি ফ্ল্যাটের মধ্যে দুটিতে ফ্যামিলি, দুটিতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের অফিস এবং একটিতে কোচিং সেন্টার ভাড়া দেয়া। দুটি দোকানের মধ্যে একটি স্টুডিও এবং আরেকটিতে সেলুন ভাড়া দেয়া। মহামারির কারণে কোনো ভাড়াটিয়াই আয় করতে পারছে না। স্টুডিও ও সেলুনের গ্রাহক না থাকায় তারাও চলে যাচ্ছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের কোনো কাজ না থাকায় পাঁচ হাজার করে তিন মাসের ১৫ হাজার টাকা ভাড়া কমিয়েছি। তবু তারা জুনের ৩০ তারিখে চলে গেছে। বাড়ির সবচেয়ে বড় ফ্ল্যাটটিতে কোচিং সেন্টার ভাড়া দেয়া ছিল। শিক্ষার্থী না থাকায় তারাও চলে গেছে। সবার অগ্রিম টাকা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় সিটি করপোরেশন থেকে খাজনা মওকুফসহ নানা ট্যাক্সে প্রণোদনা প্রয়োজন।
বাড়ি ভাড়া থেকে বাঁচতে অনেকে রাতের আঁধারে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে। মান্ডার বাড়ির মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, এক ভাড়াটিয়া চার মাসের ভাড়া দেননি। ৪০ হাজার টাকা ভাড়া জমিয়ে বললেন, জিনিসপত্র বিক্রি করে ভাড়া দিয়ে গ্রামে চলে যাবেন। কিন্তু পরে সব জিনিসপত্র বিক্রি করে রাতে পালিয়ে গেছেন।
মুগদার মুজাহিদ নামের এক ভাড়াটিয়া বলেন, একটি ইন্স্যুরেন্সে কাজ করি। গত তিন মাসে কোনো আয় নেই। পাশাপাশি ছোট একটি ব্যবসা করতাম। তাও চার মাস ধরে বন্ধ। আর চালু করতে পারব কি-না জানি না। বাসা ভাড়াসহ প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা খরচ। আয় না থাকলে এ খরচ কীভাবে মেটাব? তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি গ্রামে চলে যাব। সেখানে অন্তত ভাড়া দিতে হবে না। যে জমি আছে আবাদ করে আর ব্যবসা করে কোনোমতে চলা যাবে। ঢাকায় থাকলে ঋণ করতে হবে। তাই গত মাসে বাড়ির মালিককে বলেছি, আগস্টে চলে যাব।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাসের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাসিন্দা এক কোটি ৭০ লাখ। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে কর্ম হারিয়ে এদের অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ‘ভাড়াটিয়া পরিষদ’নামের ঢাকার ভাড়াটিয়াদের সংগঠন বলছে, বাড়ি ভাড়ার চাপের কারণে এরই মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি ভাড়াটিয়া রাজধানী ঢাকা ছেড়েছেন।
ঢাকাভিত্তিক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এক জরিপ বলছে, করোনার কারণে দেশের অন্তত দেড় কোটি মানুষ স্থায়ী কাজ হারিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনার পাশাপাশি নিম্নবিত্ত চাকরিজীবী এবং শ্রমিক শ্রেণিসহ নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সরকার বিশেষ পদক্ষেপ না নিলে এই পরিস্থিতি থেকে বেশিরভাগ মানুষেরই বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকার ৮০ শতাংশ বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন। অর্থাৎ বাড়িওয়ালার দৈনন্দিন ব্যয় ছাড়াও সন্তানের শিক্ষার খরচ এবং বয়স্কদের চিকিৎসা খরচ প্রাপ্ত বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া ৭৫ শতাংশ বাড়িওয়ালা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকেন। করোনার এই মহামারিতে ভাড়াটিয়া না থাকায় সত্যিই বেকায়দায় পড়েছেন বাড়িওয়ালারা।
এসআই/এইচএ/এমএআর/এমএস