জাতীয়

বাড়িওয়ালাদের সমস্যার কথা তো কেউ বলছেন না!

মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) স্থবির করে দিয়েছে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বকে। করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে ধাক্কা লেগেছে, তাতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। আয় কমে গেছে অগণিত মানুষের। ঢাকা নগরে আগে যারা কাজের সুবাদে ভাড়ায় থাকতেন, তারা এ পরিস্থিতিতে চলে গেছেন বাড়িতে। অনেকে বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে রেখেছেন বাড়ির মালিককে। এ কারণে এখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভাড়াটিয়া সংকট দেখা দিয়েছে।

Advertisement

রাজধানীর অন্যান্য এলাকার মতো রামপুরার বাড়িতে বাড়িতে ঝুলছে ‘টু লেট’। এ এলাকার কোনো কোনো বাড়ির মালিক তিন মাস ধরে ‘টু লেট’ ঝুলিয়ে রেখেও ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছেন না। ভাড়াটিয়া খুঁজে না পেয়ে কোনো কোনো বাড়ির মালিক বর্তমানে যেসব ভাড়াটিয়া আছেন তাদের কাছ থেকে কিছু ভাড়া কম রাখছেন। অবশ্য এমন বাড়ির মালিকও আছেন, যারা মাসের পর মাস বাসা ফাঁকা থাকার পরও ভাড়া কমাচ্ছেন না।

আবার কোনো কোনো ভাড়াটিয়া করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সেবাবাবদ অতিরিক্ত বিল আদায়ের অভিযোগও করেছেন মালিকের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, এই মহামারিতেও মালিক ভাড়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিচ্ছেন না। উল্টো আগের চেয়ে পানি ও বিদ্যুতের বিল বেশি আদায় করছেন।

পূর্ব রামপুরার বাড়ির মালিক সজীব বলেন, আমাদের ছয়তলা বাড়ির চারটি ফ্ল্যাট মার্চ মাস থেকে খালি। কয়েক জায়গায় বাসা ভাড়ার নোটিশ ঝুলিয়ে রেখেছি, কিন্তু গত তিন মাসে একটি ফ্ল্যাটও ভাড়া হয়নি। আবার যারা ভাড়ায় রয়েছেন তাদের কয়েকজন দুই মাসের ভাড়া বকেয়া রেখেছেন। ভাড়া চাইলে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলেন। এ পরিস্থিতিতে জোর করে নামিয়েও দিতে পারছি না।

Advertisement

তিনি বলেন, আমাদের বাড়তি কোনো আয় নেই। এই বাড়ি ভাড়ার ওপরই চলতে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে সবাই ভাড়াটিয়াদের সমস্যার কথা বলছেন। আমাদের সমস্যার কথা কেউ তো বলছেন না, দেখতেও চাচ্ছেন না! আমরা আর কত ছাড় দেব?

পশ্চিম রামপুরার বাড়ির মালিক মনির হোসেন। তিনি বলেন, আমার ভাড়াটিয়াদের এপ্রিল ও মে মাসের ভাড়া তিন হাজার করে ছয় হাজার টাকা মাফ করে দিয়েছি। এছাড়া জুন মাস থেকে আগের ভাড়া থেকে এক হাজার টাকা করে কমিয়ে দিয়েছি। এরপরও দুই মাস ধরে আমার তিনটি ফ্ল্যাট ফাঁকা। এ পরিস্থিতিতে নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়া বেশ সমস্যার হয়ে গেছে

পশ্চিম রামপুরার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি যে বাড়িতে ভাড়া থাকি তার একাধিক ফ্ল্যাট ফাঁকা রয়েছে। আমাদের দুই মাসের ভাড়া বকেয়া পড়েছিল। পরে দুই মাসের ভাড়া একসঙ্গে দেয়ায় মালিক পাঁচ হাজার টাকা ছাড় দিয়েছেন। কিন্তু ভাড়া কমাননি। আগামী মাস থেকে আগের ভাড়াই দিতে হবে। মালিক বলেছেন, অন্য কোথাও কম ভাড়া পেলে চলে যেতে, সমস্যা নেই। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাসা পরিবর্তন করাই বড় সমস্যা, সে কারণে থেকে যেতে হচ্ছে।

পূর্ব রামপুরার ভাড়াটিয়া আশরাফ বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী এবং আমাদের একটা ছোট বাচ্চা আছে। দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। আগে পানির বিল দিতে হতো ৫০০ টাকা। জানুয়ারি থেকে তা বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করেছেন মালিক। এপ্রিলে ৮০০ টাকা এবং মে মাসে ৯০০ টাকা দিতে হয়েছে। পানির বিল এত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাড়ির মালিক বলেন, গোটা বাড়ির বিল যা এসেছে তা সবার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। ওয়াসা থেকে অতিরিক্ত বিল দিলে আমাদের কিছু করার নেই। পানির বিল যা আসবে সবাইকে সমান ভাগে দিতে হবে।

Advertisement

আশরাফ আরও বলেন, পানির বিলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিলও দুই মাস ধরে বেশি আসছে। বাড়ির মালিককে বলে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো বাড়ির মালিক বলেন, এই বিল দিয়েই থাকতে হবে। ভালো না লাগলে বাসা ছেড়ে দিতে পারেন।

পূর্ব রামপুরার আরেকটি বাসার ভাড়াটিয়া মামুন বলেন, দুই মাস অফিস বন্ধ ছিল। এখন অফিস খুললেও দুই মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। খাই না খাই, বাড়ি ভাড়া ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। মালিক এক টাকাও ছাড় দিচ্ছেন না। ছেলে-মেয়ে নিয়ে এই পরিস্থিতিতে নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে শিফটও করতে পারছি না। বাধ্য হয়েই সবকিছু মেনে নিয়ে থাকতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার জাগো নিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অনেকেরই আয় কমেছে। এ অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করা অনেকেরই জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি, নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করার জন্য, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছেন না। অনেক মানুষ বেকার এবং আয় কমার কারণে তাদের পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর আয়ের আশায় তিনি নিজে কোনো একটি মেসে বা কম টাকা ভাড়ার বাসায় উঠেছেন। সত্যি কথা বলতে, মানুষকে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। যে কারণে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতিতেও অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াদের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে ভাড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। যে কারণে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ভাড়াটিয়াদের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে বাড়ির মালিকদের উচিত কিছুটা ছাড় দেয়া, কিছুটা ভাড়া মওকুফ করা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকার ৮০ শতাংশ বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাড়িই যেহেতু তাদের ব্যবসা, তাই বিভিন্ন বিল ও করের ঊর্ধ্বগতি সাপেক্ষে তারা বছরে গড়ে ৯ শতাংশ ভাড়া বাড়ান। ৭৫ শতাংশ বাড়িওয়ালা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিংবা সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকেন। বাড়ি ভাড়া ছাড়া সাধারণত তাদের অন্য কোনো আয়ের উৎস থাকে না। তাই ঋণের কিস্তি পরিশোধ কিংবা সংসার চালানোর তাগিদে ভাড়া হাতে পাওয়া তার জন্য জরুরি।

এমএএস/এইচএ/এমএআর/এমএস