জাতীয় সংসদ পুতুল নাচের নাট্যশালায় পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। রাজধানীতে রোববার দুপুরে সংস্থাটির পার্লামেন্ট ওয়াচ প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় কিছু তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সংসদ কার্যকরে ১২ দফা সুপারিশও করা হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা তিন জোটের রূপরেখার অন্যতম অঙ্গীকার ছিল সংসদকে কার্যকর করা। এরশাদের পতনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের দিকেই আবার অভিযাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। প্রত্যাশা ছিল সংসদই হবে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সে প্রত্যাশা কতোটা পূরণ হয়েছে সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। কয়েকটি সংসদ মেয়াদ পূরণ করলেও সংসদীয় রীতিনীতি থেকে সরকার, বিরোধীদল ছিল অনেকটাই দূরে। পাল্লা দিয়ে সংসদ বর্জনের ঘটনা ঘটেছে। যারাই যখন বিরোধী দলে থাকে সংসদমুখি হতে তাদের বড়ই অনিহা। এমনকি সরকারের দুই তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও কোরাম সংকটের কারণে সংসদের অধিবেশন বসতে দেরি হয়েছে। এতে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হয়নি সংসদ কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া টিআইবির প্রতিবেদনেও বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জুলাই পর্যন্ত সংসদীয় কার্যক্রমের ওপর এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। সংসদীয় আচরণ থেকে ব্যাপক বিচ্যুতি ঘটেছে। প্রতিপক্ষের সমালোচনা আগের সংসদের চেয়ে ১২ গুণ বেড়েছে। আইন প্রণয়নে মোট কার্যদিবসের মাত্র ৬ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা আরও বলা হয়, নিজ দল ও সরকার দলের প্রশংসা হয়েছে ৭৫০০ বার, সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোটের সমালোচনা হয়েছে ৭২৬৮ বার। প্রশ্নবিদ্ধ প্রধান বিরোধী দলের প্রত্যাশিত জোরালো ভূমিকার ঘাটতি, সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোট নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনা ও অশালীন ভাষার প্রাধান্য, অসংসদীয় আচরণ ও ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারের শক্তিশালী ভূমিকার অনুপস্থিতি, বিধান থাকলেও আন্তর্জাতিক চুক্তিবিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠিত না হওয়া, আইন প্রণয়ন, প্রশ্নোত্তর ও জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশের আলোচনায় সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, কমিটির সদস্যদের ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতাসহ স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সংসদীয় কার্যক্রমে তথ্যের উন্মুক্ততা ও অভিগম্যতার ঘাটতি ইত্যাদি কারণে সংসদ প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর হয়নি।এ ব্যাপারে সংসদকে কার্যকর করতে কিছু সুপারিশও করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- অসংসদীয় আচরণ এবং ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারকে অধিকতর শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা, সরকার এবং বিরোধী উভয় পক্ষকে অসংসদীয় আচরণ ও ভাষা পরিহার করা, সংসদে কথিত প্রধান বিরোধী দলকে বিতর্কিত অবস্থান পরিহার করে প্রকৃত ভূমিকা পালন করা, আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে সদস্যদের অধিকতর অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, প্রশ্নোত্তর ও জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিশ পর্বে অধিক সময় বরাদ্দ এবং সদস্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি। এ কথা ঠিক সংসদ কার্যক্রমে এখন অনেকটাই স্বচ্ছতা এসেছে। সংসদ টিভির মাধ্যমে সংসদের কার্যক্রম সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে। সংসদীয় কমিটির সভাপতিও নেয়া হচ্ছে বিরোধী দল থেকে। প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিচ্ছেন। এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক দিক। তবে সত্যিকার অর্থে সুফল পেতে হলে সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে সংসদকে। জনসম্পৃক্ত সকল বিষয় নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে হবে। সংসদ কার্যকরে বিরোধী দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিরোধী দলকে এক্ষেত্রে ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করতে হবে। আজ্ঞাবহ সংসদ আর যাই হোক গণতন্ত্রের জন্য কখনোই সহায়ক নয়। টিআইবির সুপারিশ গুলোও বিবেচনা নিতে হবে। বক্তব্য দিয়ে কোনো কিছু উড়িয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। কথা কে বললো সেটি বড় নয়, কথার মধ্যে সারবত্তা আছে কি না সেটাই বিবেচ্য। এইচআর/পিআর
Advertisement