বিশেষ প্রতিবেদন

তিনজন ডাক্তারের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না কক্সবাজারের বিমান চলাচল

তিনজন ডাক্তারের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না কক্সবাজারের বিমান চলাচল

বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনের জন্য গোটা জেলা শহরে নাকি তিনজন চিকিৎসক নেই। মাত্র তিনজন চিকিৎসকের অভাবেই চালু করা যাচ্ছে না বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের জেলা কক্সবাজারের বিমান চলাচল। এতে শত শত কোটি টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও দেশের এয়ারলাইন্সগুলো।

Advertisement

সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর (নীলফামারী) এবং যশোর রুটের ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে ফ্লাইট চালানোর অনুমতি দেয়া হয়নি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট কক্সবাজারে। এ বিষয়ে বেবিচক বলছে, ফ্লাইট চলাচলে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন (আইকাও) যেসব পূর্বশর্ত দিয়েছে সেগুলো পূরণ করতে না পারায় এখনো কক্সবাজার বিমানবন্দরকে অনুমতি দেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আইকাওয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ফ্লাইট চলাচল শুরু করতে হলে বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসক থাকতে হবে। যেন একজন রোগী প্লেনে অসুস্থ বোধ করলে বিমানবন্দরে নেমে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে পারে। যেসব বিমানবন্দর চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে সেখানেই ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আজ ২ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে চিকিৎসকের বিষয়ে কোনো আপডেট জানানো হয়নি।

কমপক্ষে কতজন চিকিৎসক হলে বিমানবন্দর চালু হতে পারে? জানতে চাইলে মফিদুর রহমান বলেন, এমন কোনো সংখ্যা নির্দিষ্ট নেই। যশোর বিমানবন্দর রোস্টার ভিত্তিতে তিনজন চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে আমাদের জানিয়েছে, আমরা সেখানে ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দিয়েছি। কক্সবাজার বিমানবন্দর এসব বিষয় নিশ্চিত করতে পারলেই তাদের অনুমতি দেয়া হবে।

Advertisement

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের জেলা কক্সবাজারে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন

কক্সবাজার বিমানবন্দর সূত্র জানায়, করোনার মহামারিতে যখন বিমানবন্দরে যাত্রীবাহী কমার্শিয়াল ফ্লাইট বন্ধ ছিল তখন এখানে দুটি বিশেষ ফ্লাইট নেমেছে। এছাড়া নিয়মিত কার্গো ফ্লাইট চলছে। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসক রাখা হয় বিমানবন্দরে। তবে বর্তমানে চিকিৎসক সংখ্যা শূন্য।

এ বিষয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দরের ম্যানেজার একেএম সাইদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, জেলার সিভিল সার্জন পাঁচজন চিকিৎসককে বিমানবন্দরে রোস্টারের মাধ্যমে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমরা তাদের বিমানবন্দরের আইডি কার্ড দিয়েছিলাম। কাগজে-কলমে এই বিমানবন্দরে এখনো পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে কক্সবাজার বিমানবন্দরের চিকিৎসকের সংখ্যা ‘শূন্য’।

Advertisement

সংকটের কারণে বিমানবন্দরে চিকিৎসক না দিতে পারার কথা স্বীকার করেন খোদ সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে বিভিন্ন কোভিড হাসপাতালে প্রচুরসংখ্যক ডাক্তার জোগান দিতে হচ্ছে। তাই বিমানবন্দরের জন্য ডাক্তার ম্যানেজ করা কঠিন। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্প থাকার কারণে কক্সবাজারে নিয়মিত যাতায়াত আছে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের, তারা চলাচল করেন আকাশপথেই

কক্সবাজারের অর্থনীতিতে ধস, দেউলিয়াত্বের পর্যটন ব্যবসায়ীরাকরোনার উদ্বেগজনক সংক্রমণের কারণে রেড জোন হওয়ায় ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউন ছিল কক্সবাজার। ১ জুলাই থেকে সীমিত আকারে খুলেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, করোনা সংকটের কারণে এ পর্যন্ত মোট ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কক্সবাজার। এই ধাক্কায় দেউলিয়াত্বের শঙ্কায় কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্টসহ পর্যটন ব্যবসা।

দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার দুদিন পর থেকেই কক্সবাজার সৈকতসহ পর্যটন স্পটগুলোতে লোকসমাগম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটনসংশ্লিষ্ট সব ব্যবসা-বাণিজ্য। শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম হলেও সাগরে নামেনি ট্রলার, দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল মাছ আহরণ ও শুঁটকি উৎপাদন। পহেলা বৈশাখ, ঈদুল ফিতরে জমজমাট ব্যবসা আশা করলেও ব্যবসায়ীদের বেচাবিক্রি ছিল শূন্যের কোঠায়। আসন্ন ঈদুল আজহায়ও যে ব্যবসা হবে, সে আশা করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, কক্সবাজারে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন দূরপাল্লার অনেক বাস ও ১০-১২টি ফ্লাইট যাতায়াত করে। পর্যটক সেবায় রয়েছে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও কটেজ এবং কয়েকশ রেস্টুরেন্ট। তবে প্রায় অর্ধেকই এখন বন্ধের পথে।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ওশান প্যারাডাইস হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের চেয়ারম্যান এম এন করিম জাগো নিউজকে বলেন, করোনাকালে পর্যটন ব্যবসায় একেবারে অন্ধকার দেখছি আমরা। পর্যটনশিল্পের বর্তমান যে অবস্থা পার করছি আমরা, আগামীতে আরও কী পরিমাণ বেগ পেতে হবে তা বুঝতে পারছি না। আমরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালাই। দিন দিন ঋণের বোঝা যেমন বাড়ছে, আমাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাও তেমন কষ্টকর হচ্ছে। আরও কিছুদিন যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে আমাদের দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে।

ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকার কারণে আসছেন না পর্যটকরা, সেজন্য কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ও ধস নেমেছে

তিনি বলেন, আমরা সরকারকে জানাতে চাই, বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেই কেবল আমরা এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো। তা না হলে একসময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে আমাদের চলে যেতে হবে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা জাগো নিউজকে বলেন, এমনিতেই সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে আমাদের অর্থনীতি নিম্নমুখী, এটা যদি কন্টিনিউ চলতে থাকে তাহলে আরও ধস নামবে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের ব্যবসা-বাণিজ্যে ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি ব্যবসায় বাণিজ্য ও পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ (হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট) খুলে দেয়া যায়, তাহলে সামনের দিনে বড় ধরনের ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে পারি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী বলেন, অনেকেই বাসে কক্সবাজারে আসতে ভয় পান। বিমান চলাচল স্বাভাবিক হলে অনেকেই কক্সবাজারে আসবেন। তাই চিকিৎসক ঘাটতি মিটিয়ে বিমানবন্দর চালুর আহ্বান জানাই। ব্যবসায়ীদের স্বার্থে প্রয়োজনে ইন্টার্ন চিকিৎসক দিয়ে হলেও বিমানবন্দর সচল করার দাবি করছি।

অনুমতি পেলেই ফ্লাইট চালাতে প্রস্তুত বেসরকারি দুই এয়ারলাইন্সকক্সবাজার রুটে ফ্লাইট বন্ধ থাকার বড় প্রভাব পড়েছে এয়ারলাইন্স ব্যবসায়। এই রুটে দেশি-বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী, এনজিওকর্মীসহ অনেকেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এছাড়া কক্সবাজারে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো স্থাপনের পর সারা বছরই এই রুটে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যাতায়াত করছিলেন। অন্যান্য রুটে যাত্রী সংখ্যা কম থাকায় এয়ারলাইন্সগুলো তাকিয়ে আছে কক্সবাজারের ফ্লাইট চালুর দিকেই।

ব্যবসায়ীরা অন্তত ইন্টার্ন চিকিৎসক দিয়ে হলেও কক্সবাজার বিমানবন্দর চালু করার দাবি জানিয়েছেন

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান মহামারিকালে অনেকেই আকাশপথে যাত্রার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া আগে অনেকেই পরিবার নিয়ে কক্সবাজারসহ কয়েকটি রুটে লেইজার ট্রিপ (অবসর ভ্রমণ) করতেন, বিজনেস ট্রিপ (ব্যবসায়িক ভ্রমণ) করতেন। বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে। এরপরও যে কম যাত্রী নিয়ে দুই বেসরকারি এয়ারলাইন্স (ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার) অন্যান্য রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে, এজন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।

এদিকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এবং নভোএয়ার উভয় প্রতিষ্ঠানের সাথেই কথা হয় জাগো নিউজের। তারা জানায়, কক্সবাজারে ফ্লাইট পরিচালনায় শতভাগ প্রস্তুত তারা। অনুমতি পেলেই বেবিচক নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৩৫০০ টাকায় টিকেট বিক্রি শুরু করবে তারা।

যদিও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু করেও যাত্রী সংকটের কারণে চলাচল স্থগিত রেখেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

এর আগে ২৪ মার্চ থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। পরে ১ জুন ঢাকা থেকে সিলেট, চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর এবং ১১ জুন থেকে যশোর রুটে ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।

এআর/এইচএ/জেআইএম