মাছুম বিল্লাহ
Advertisement
পাট উৎপাদনের ইতিহাস আমাদের সেই গত তিনশ বছরের। বাংলার গর্বের ইতিহাস ‘সোনালী আঁশ’। অথচ এ যেন কোনো গুরুত্বই পাচ্ছে না। পাটের জায়াগা দখলে করেছে পলিথিন যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, আমাদের শরীরের জন্যও ক্ষতিকর। তারপরও সেটিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে, প্রমোট করছি অথচ সোনালী আঁশ অবহেলিতই থেকে গেল। পরিবেশের ক্ষতি আসে ধীরে ধীরে। সেই সর্বনাশকে আমরা পাত্তাই দিচ্ছি না। কিন্তু এক পশলা বৃষ্টির পর সব শহর ও নগরীর রাস্তাঘাট যে পানির নিচে তলিয়ে যায় সেটিতো একেবারেই সাক্ষাৎ বিপদ, তার মূল কারণ তো এই পলিথিন। অথচ কত চমৎকার পরিবেশবান্ধব পাট, আমার দেশের অর্থকরী ফসল সেটিকে আমরা অদক্ষতা, দুর্নীতি আর চরম অবব্যস্থাপনার কারণে পায়ে ঠেলে দিয়ে আসছি অনেক বছর ধরে।
এই পাট উৎপাদনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কতশিল্প, কত কারখানা। কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এসব মিল-কারখানায়। সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমরা পায়ে ঠেলে দিয়েছি পুরো পাটশিল্প চক্রকে। পায়ে ঠেলতে ঠেলতে সোনালী আঁশ তার সব ঐতিহ্য হারিয়ে হয়েছে পুরোনো দিনে ইতিহাস, হয়েছে এক বেদানার প্রতীক। কৃষক পাট উৎপাদন করে বিক্রয়মূল্য না পেয়ে পাটে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পাটকলগুলোকে আমরা বন্ধ করে দিই। বন্ধ করে না দিলে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে এগুলোকে পুষে রাখতে হয়। কত বড় অনিয়ম, কত বড় দুর্নীতি, কত বিশাল অব্যবস্থাপনা! কী নিয়ে আমরা বড়াই করি, কী নিয়ে এত কণ্ঠফাটাই। সীমাহীন অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র সর্বত্রই এত প্রকট যে, যেকোনো বিবেকবান ও দেশপ্রেমিক মানুষকে আঁতকে উঠতে হয়।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসলই ছিল পাট। এই পাট সুনাম কুড়িয়েছিল বিশ্বজুড়ে কারণ বিশ্বের আর কোথাও পাট ফলানোর মতো উর্বর ও উপযুক্ত মাটি প্রকৃতি দেয়নি। এটি ছিল আমাদের গর্বের, আমাদের একক সম্পদ। কিন্তু অযত্ন, অবহেলা, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি আর অনীতির ফলে পাটের আজ এই দুদর্শা! বিশ্বের সর্ববৃহৎ জুটমিলস গড়ে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জে, যেখানে লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু হায়! আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। শুধু অব্যস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম আর অপরাজনীতির কারণে। তৎকালীন সরকারকে আমরা কড়া সমালোচনা করে লিখেছিলাম, কথা বলেছিলাম। কিন্তু এখন কী হলো? আসলে এ তো আমাদের জাতীয় দুর্ভাগ্য।
Advertisement
কেউই আমরা পাটের সুনামকে, রাষ্ট্রীয় অব্যস্থানপাকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারিনি, পারছি না। আরও দুঃখের বিষয় হচ্ছে পাট উৎপাদনের মাটি হচ্ছে বাংলাদেশ যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল (খুলনা, নারায়ণগঞ্জে) বড় বড় পাটকল। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করতেন এসব মিলে। আয় হতো প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা কিন্তু আমার দেশের সব পাটকল বন্ধ করে, ধ্বংস করে দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গড়ে উঠছে শত শত পাটকল। এ কেমন রাজনীতি? দেশের কৃষককে ঠকিয়ে, দেশের মানুষকে বেকার বানিয়ে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতিয়ারকে পুরোপুরি ধ্বংস করে যে দেশে পাট উৎপাদন হয় না সেখানো আমরা পাটকল গড়ার উৎসাহ ও উদ্দীপনা দিচ্ছি। এ কেমন ব্যবস্থা আমাদের বুঝে আসে না।
ধারাবাহিক লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেল সরকারি ২৫টি পাটকল। তবে বন্ধের পর সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদনমুখী করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। দুর্নীতির পাহাড়ের দেশে সেটি কি সম্ভব? সেটি হয়তো হবে রাষ্ট্রীয় অর্থ নয়ছয় করার আর একটি উপায়। বন্ধ ঘোষিত পাটকলগুলোর প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করা হবে। পাটকলগুলোতে কর্মরত ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারী রয়েছেন। ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত আট হাজার ৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন। অর্থ সংকটে তাদের অবসারভাতা পরিশোধ হয়নি। তাদের পাওনাবাবদ এক হাজার ৩০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
গত ৪৮ বছরে সরকারকে এ খাতে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ষোল কোটি মানুষের দেশে পাটজাতদ্রব্য বিভিন্ন কাজের জন্য উৎপাদিত হলে, ব্যবহৃত হলে পাটকলগুলোতো লোকসানের মুখে পড়ার কথা নয়। সেটি করার জন্য কি আমাদের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই? আমাদের ৩১৪টি পাটকলের মধ্যে ৬৩টি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পাটকল সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকল ২৭টি। এর মধ্যে তিনটি ননজুটমিলস রয়েছে। এই সংখ্যা এখন ৩৩টি নতুন ছয়টি যুক্ত হওয়ার কারণে। এর মধ্যে আবার বন্ধ রয়েছে সাতটি। আর বাকিগুলোতে চলছে লুটপাট আর লোকসানের মহামারি যা করোনাভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক। এর কোনো প্রতিষেধক কিংবা ওষুধ কোনো সরকারই বের করতে পারেনি। বেসরকারি খাতে রয়েছে ২৮১টি পাটকল, যার মধ্যে বন্ধ রয়েছে ৫৬টি। তবে বেসরকারিগুলোতে এত লোকসান হচ্ছে না, কয়েকটিতে ভালো লাভও হচ্ছে।
আমরা তো এটি জানি যে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। কিন্তু এ জন্য যারা দায়ী তাদের কিছু হবে না? সেইসব শ্রমিক নেতা যারা কাজ না করে, শিল্পকারখানায় উৎপাদন না করে দিনের পর দিন ক্যান্টিনে আড্ডা মারে, মিটিং মিছিল করে, মন্ত্রী-এমপিদের সাথে চলে। তারা তো তাদের আখের ঠিকই গুছিয়ে ফেলে। কিন্তু কী হবে হাজার হাজার শ্রমিক এবং ওপর নির্ভরশীল মানুষদের? কী হবে আমাদের পাটচাষীদের? এ তো প্রকৃতিরই সৃষ্টি। আমার দেশে হয় পাট, আরবের ভূমিতে হয় খেজুর। আমাদের তো প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে হবে। আমরা তো পাটকে খেজুর দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারব না।
Advertisement
পাটকেই আমাদের ধরে রাখতে হবে অর্থনীতির স্বার্থে, প্রকৃতির স্বার্থে, ঐতিহ্যের স্বার্থে, পরিবেশের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে। কিন্তু কেন সেটি করছি না? সমস্যাগুলো কেন হয় তার মূল না খুঁজে সহজ একটি সমাধান বের করে ফেলি যা দেশ ও মানুষের জন্য বয়ে নিয়ে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। আমাদের পাট মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু এসব মন্ত্রণালয়ের কী কাজ? আমরা ট্যাক্সের টাকার বিশাল মন্ত্রণালয় পুষছি আর পাটচাষীরেদর দুর্দিন ডেকে আনছি। বিজ্ঞানীদের দেশে কদর নেই, সুনাম নেই তারা বিদেশে গিয়ে পাটের জিনম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেন। আগামীতে পাটের সুদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু না এদেশে তা হলো না।
ব্রিটিশ রাজের আদলে গড়া প্রশাসন ক্যাডার যারা সকল বিভাগকে দখলে রাখতে চায়, যারা মনে করে আমরাই ‘রাজকীয় ক্যাডার’। আর তাদের শেখানো হয় কীসের প্রধান শিক্ষক, কীসের অধ্যক্ষ আর কীসের ভিসি- আমরাই সব। আর তাই অনেক আমলা গল্পও করে থাকেন ‘ভিসিদের তারা বসিয়ে রাখেন তাদের সাথে দেখা করানোর জন্য।’ তাদের শেখানো হয় প্রিন্সিপাল সাব, ভিসি সাব কারণ তারা যে ক্যাডারের রাজা। ব্রিটিশ রাজের এইটুকু আমরা ধরে রেখেছি। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে একটি ব্রিজ, একটি স্থাপনা যে আজও শক্ত, আজও মজবুত সেটি আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আমরা আজ একটা স্থাপনা তৈরি করলে পরের বছর থেকে সেখানে হাত দিয়ে হয়। একটি ফুল হতে আমরা যেন বিষটুকুই নিয়েছি, মধুকে অগ্রাহ্য করেছি।
এভাবে চলতে থাকলে কী হবে আমাদের? আমরা গার্মেন্টস শিল্পকে তো ধ্বংস করে ফেলেছি। যেটি আমাদের লাখ লাখ অদক্ষ শ্রমিকের কাজের জায়গা ছিল। পাটের মতো অত্যধিক সম্ভাবনাময় শিল্পকে আমরা মাটিতে বসিয়ে দিলাম? শ্রমিক ছাঁটাই করাই পাটশিল্পের সমাধান? এই পাটশিল্পের দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তারা নিশ্চয়ই ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ। তাদের তো কিছু হবে না, হচ্ছে না। পাটশিল্পের দুর্গতির বলি হচ্ছেন শ্রমিকরা। ক্ষতি হচ্ছে দেশের। কে ভাববে এসব নিয়ে? দেখার যেন কেউ নেই।
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক
এইচআর/বিএ/পিআর