সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) তাদের প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রতিবেদনে অস্ত্র তৈরি, নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ভারতের দেওয়া পারমাণবিক তথ্য এবং অস্ত্র মজুতের প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
Advertisement
এসআইপিআরআই জানাচ্ছে, পাকিস্তানের মজুতে আরও ১০টি পারমাণবিক অস্ত্র যোগ করেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত প্রেক্ষাপটে ভারতের আরও কম সংখ্যক পারমাণবিক ওয়্যারহেড রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে তারা।
তবে এতে অন্যান্য স্বতন্ত্র সূত্রগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যারা ভারতের পারমাণবিক মজুতের পরিমাণ আরও বেশি বলে উল্লেখ করেছে। এছাড়া এসআইপিআরআই এমনকি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপন্সের (আইসিএএন) সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টকে বিবেচনায় নেয়ার কথাও বিবেচনা করেনি।
ওই রিপোর্টে নয়টি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের বার্ষিক পারমাণবিক ব্যায়ের হদিস তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে উল্লেখিত সবচেয়ে কৌতুহল উদ্দীপক আলোচনাটি হলো, পারমাণবিক শক্তির পেছনে পাকিস্তানের ব্যয় যেখানে একশত কোটি ডলার, সেখানে একই সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভারতের ব্যয় হলো ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
Advertisement
ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচি গতি বাড়াচ্ছে, বলছে রিপোর্ট
ভারত এখন নন-এনপিটি পারমাণবিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্রুততম গতিতে সুরক্ষার বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সম্প্রসারণ করছে। ভারত পারমাণবিক ত্রয়ী গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক শক্তি চালিত ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন, আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম), সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক মিসাইল (এসএলবিএম), দ্বৈত ব্যবহারোপযোগী ক্রুজ/ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং ব্যাপকভিত্তিক নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন, যেটার উদ্দেশ্য হলো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পারমাণবিকীকরণ।
ভারতের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদরা দাবি করে থাকেন, কৌশলগত শক্তির জন্য ভারতের ৩০০-৪০০’র বেশি পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োজন। ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. অনিল কাকোদকার এ ব্যাপারে বলেছেন যে, ‘দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা এবং ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন– উভয় বিবেচনায় দ্রুত বিকাশমান এই কর্মসূচিকে শুধুমাত্র বেসামরিক তালিকায় সীমিত রাখা যায় না। এতে ভারত বাধা পড়ে যাবে এবং ভারত নিশ্চিতভাবে একটির বিনিময়ে অন্যটিতে ছাড় দিতে পারে না।’
তাই, ভারত ইচ্ছে করেই তাদের দ্রুত উৎপাদনশীল রিয়্যাক্টর এবং তাদের অধিকাংশ তথা-কথিত বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) সুরক্ষা ও নজরদারির বাইরে রেখেছে। পারমাণবিক ত্রয়ী সক্ষমতা অর্জনের জন্য ভারত আইএইএ’র নজরদারির বাইরে আরও অনেক পারমাণবিক ওয়্যারহেড তৈরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
Advertisement
আইএইচএস জেনসে রবার্ট কেলি তার ইন্টেলিজেন্স রিভিউতে যাচাই করে দেখেছেন, একটা আবদ্ধ পারমাণবিক জ্বালানি চক্র চালু করতে যে পরিমাণ ও যে বিশুদ্ধতার ইউরেনিয়াম দরকার হয়, বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে ভারত সেগুলো পেতে সক্ষম। একসঙ্গে অ্যাটমিক ভেপার লেজার আইসোটোপ সেপারেশানের (এভিএলআইএস) ব্যাপারেও নয়াদিল্লি আগ্রহী বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
এদিকে, বেলফার সেন্টারের গবেষণায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, ভারত ইতোমধ্যে পাঁচটি দ্রুত উৎপাদনশীল রিয়্যাক্টর স্থাপন করেছে, যেগুলো তাদের অস্ত্র তৈরীর উপযোগী প্লুটোনিয়ামের উৎপাদন সক্ষমতা ২০ গুণ বাড়িয়ে দেবে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা গেছে যে, নয়াদিল্লি প্রতি বছর ৮০ থেকে ৯০টি প্লুটোনিয়াম-ভিত্তিক এবং ৭ থেকে ৮টি ইউরেনিয়াম-ভিত্তিক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম।
পারমাণবিক ত্রয়ী সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছে ভারত
পারমাণবিক ত্রয়ী পূর্ণ করার জন্য ভারত দ্রুত বিভিন্ন ছদ্ম-প্রকল্পের অধীনে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সম্প্রসারণ করছে। এমনকি, তারা ধ্রুব নামের একটি প্লুটোনিয়াম উৎপাদন রিয়্যাক্টর, এবং একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ফ্যাসিলিটি চালাচ্ছে, যেগুলো আইএইএ’র সুরক্ষার আওতায় পড়ে না।
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় পারমাণবিক সামরিক কমপ্লেক্স, আনবিক গবেষণা গবেষণাগার গড়ে তুলছে। এই ফ্যাসিলিটি ভারতকে অনেক বড় ধরণের পারমাণবিক অস্ত্র ও হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সক্ষমতা দেবে।
ইন্দো-মার্কিন পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তির কারণে গোপন প্লুটোনিয়াম রিজার্ভগুলো পরিদর্শন করা হয়নি এবং ভারতের অস্ত্র উন্নয়ন ফ্যাসিলিটিগুলোর ওপর তা ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আল-জাজিরা ও ফরেন পলিসির তদন্ত রিপোর্টে এটাও বলা হয়েছে যে, অস্ত্র প্রতিযোগিতা জোরদার করতে ভারত গোপনে চাল্লাকেরেতে একটি পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কমপ্লেক্স তৈরি করছে। এটা আগামী বছরগুলোতে গোপনে ভারতের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে তিনগুণ বৃদ্ধি করবে।
প্রযুক্তিগত ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে মজুতের তথ্য লুকাচ্ছে ভারত
আইএইএ’র কাছে একটা সন্দেহজনক পারমাণবিক বিচ্ছিন্নতার পরিকল্পনা তুলে ধরেছে ভারত। বেসামরিক তালিকায় যেসব ফ্যাসিলিটিগুলো রয়েছে; যেগুলোর কৌশলগত কোনো প্রভাব নেই, সেগুলো আইএইএ’র সামনে তুলে ধরে সেগুলোর সুরক্ষার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
অথচ আইএইএ’র সুরক্ষার বাইরে যে সব বেসামরিক প্লুটোনিয়াম রিজার্ভ রয়েছে; যেগুলোকে কৌশলগত উদ্দেশ্যের জন্য আলাদা করা হয়েছে, সেগুলোই প্রকৃত উদ্বেগের বিষয়।
তিন ধাপের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত তাদের সুরক্ষাহীন পারমাণবিক শক্তি কর্মসূচি সম্প্রসারণের কাজ অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া বেশ কয়েকটি পারমাণবিক রিয়্যাক্টর স্থাপনেরও ঘোষণা দিয়েছে নয়াদিল্লি। এই সক্ষমতা থেকে অতিরিক্ত ফিসাইল বস্তু তৈরি হবে, যেটা বিভিন্ন উৎপাদনকারী ও নৌ রিয়্যাক্টরের চাহিদার চেয়ে পরিমাণে বেশি।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার দিক থেকে ভারত চীন, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে তারা।
সামরিক আধুনিকায়ন কর্মসূচিতে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য ভারত তাদের কৌশলগত ক্রয় এবং অস্ত্র তৈরির উপযোগী সরঞ্জামাদির মজুদ গড়ে তুলছে। নয়াদিল্লি যেভাবে অস্ত্র তৈরির উপযোগী পারমাণবিক পদার্থের মজুদ গড়ছে, সেটা দক্ষিণ এশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে কৌশলগত স্থিতিশীলতার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
বেশ কিছু পারমাণবিক সরবরাহকারী ভারতের মজুত সম্পর্কে অবাস্তব ধারণার কারণে নয়াদিল্লির সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি করেছে। যদিও এসব দেশগুলো থেকে পাওয়া উপাদানগুলো ভারতের সামরিক শক্তি সম্প্রসারণ নীতির অংশ হিসেবে অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচি পাকিস্তানের আগে শুরু হয়েছিল, শুধুমাত্র এই কারণেই আইএইএ সুরক্ষার আওতার বাইরে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতা ভারতের রয়েছে।
এ ছাড়া ২০০৮ সালে এনএসজি কর্তৃক ভারতকে ১৪টি পারমাণবিক চুক্তিতে ছাড় এবং নেতৃস্থানীয় পশ্চিমা দেশগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত যেভাবে পারমাণবিক ত্রয়ী অর্জনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেগুলো এটা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট যে, ভারতের বিপজ্জনক ও সম্প্রসারণবাদী পারমাণবিক আকাঙ্খার সাথে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি কোনভাবেই মেলানো যাবে না।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
এসএ