বেশি বেশি টেস্ট, যথাযথভাবে কোয়ারেন্টাইন মেনে চলা ও লকডাউনের মাধ্যমেই করোনা মহামারি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এটা যে অত্যন্ত কার্যকরী সেটা ইতোমধ্যেই ভিয়েতনাম করে দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন ভিয়েতনামের করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জাতীয় কমিটি ও র্যাপিট রেসপন্স ইনফরমেশন টিমের সদস্য ড. ফাম কুয়াঙ থাই। মঙ্গলবার (৩০ জুন) বিকেল ৩টায় অনলাইন মিটিং প্ল্যাটফর্ম জুমের মাধ্যমে ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এ কথা জানান তিনি। আর্ক ফাউন্ডেশন ও সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্স (সিএলপিএ) যৌথভাবে আয়োজিত এ ওয়েবিনারে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, অ্যাকাডেমিশিয়ান, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। এটি সঞ্চালনা করেন আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক।
Advertisement
ড. ফাম কুয়াঙ থাই বলেন, আমরা অন্যান্য দেশের অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করেছি। বেশি বেশি পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্তদের খুঁজে বের করে অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করে ফেলা হয়েছে। নিখুঁত কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা এবং অন্তত দুবার পরীক্ষা করে তাদের বিষয়ে নিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কোথাও রোগীর সংখ্যা বেশি হলে সেসব জায়গা লকডাউন করা হয়েছ। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গেলে তার ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভিয়েতনামে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে ২৫টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। পারস্পরিক সমন্বয়ের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সম্মুখযুদ্ধে শত্রুর সঙ্গে যেভাবে যুদ্ধ করা প্রয়োজন করোনা মোকাবিলায় সেটাই ভিয়েতনাম করেছে। ফলে ইতোমধ্যে সফলতাও পাওয়া গেছে। ভিয়েতনামে প্রতি এক হাজার জনে মাত্র একজন আক্রান্ত পাওয়া গেছে। ড. ফাম কুয়াঙ থাই বলেন, করোনা ঠেকাতে টেস্টের কোনো বিকল্প নেই।
এসময় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘করোনা মোকাবিলার জন্য যথাযতভাবে নিরাপদে থাকতে হবে। ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এজন্য নানা ধরনের যে ঝুঁকি রয়েছে তা চিহ্নিত করলেই এ মহামারির সমাধান সম্ভব।’
Advertisement
যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যুফিল্ড সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান টলিব মিরজয়েভ বলেন, ‘কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ কোরিয়া উভয়ই স্পষ্টতই অন্যদেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে। তারা অন্যদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতে সুস্থ হওয়ার হার সবচেয়ে কম এবং করোনা মোকাবিলায় তাদের নেয়া পদক্ষেপ দ্রুত ও কার্যকর না হওয়ায় বিশেষজ্ঞদের তীব্র সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। তাই এটা প্রমাণিত যে, উপকরণ ও সম্পদের সহজলভ্যতাই সফলভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার পূর্বশর্ত নয়; এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা ও তার কার্যকর প্রয়োগ।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো সংকট মোকাবিলায় সংকট সম্পর্কে আগেই সচেতন থাকা, সংকট এড়ানো, প্রতিরোধ, নির্মূল, প্রতিক্রিয়া এবং অবশেষে নিজেকে রূপান্তরিত করার পদ্ধতিগত সক্ষমতা থাকতে হবে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, ব্যাপকহারে পরীক্ষা, ট্র্যাক এবং ট্রেস করা প্রয়োজন। প্রতিটি দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই স্বতন্ত্র। তাই এক দেশের অভিজ্ঞতা অন্য দেশে কাজে লাগানোর সময় সে দেশের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।’
যুক্তরাজ্যের লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সিনিয়র হেলথ ইকোনমিস্ট ড. জাহাঙ্গীর খান বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত স্বাস্থ্য বাজেট একেবারেই প্রচলিত ও সাধারণ একটি বাজেট। কারণ এ বাজেটে করোনা মহামারিকে কোনো বিবেচনায় নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে, স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটাও একেবারেই পরিকল্পনাহীন। করোনা-পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বে সেটা নিয়ে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া যেভাবে পরিকল্পনা করেছে, বাংলাদেশ তা করছে না।’
ওয়েবিনারে বাংলাদেশ প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের সাবেক পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, ‘পরিচিত অসংক্রামক রোগ ও মানসিক রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেতে অনিচ্ছুক। একই সঙ্গে, ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা, গণপরিবহন লকডাউন, আয় হ্রাস এবং শারীরিকভাবে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে অনেকেই চিকিৎসা সেবা গ্রহণ থেকে বিরত আছেন। তবে মনে রাখতে হবে, সরবরাহ খাতের অদক্ষতার পাশাপাশি দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা ও বেসরকারি হাসপাতালের ঘাটতি করোনা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে।’
Advertisement
সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি ও নীতি বিশ্লেষক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে সংক্রামক রোগ-সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। আইনের প্রয়োগ নিষেধাষ্ণা, জরিমানা ও শাস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মানবিক বিষয়গুলো বিবেচনা নিয়ে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। কাভিড-১৯-এর সকল জরুরি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটি ন্যাশনাল হেলথ কমান্ড গঠন করা জরুরি।’
সঞ্চালক অধ্যাপক ড. রুমানা হক তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় আমাদের তাৎক্ষণিক, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
পিডি/এসআর