বিশেষ প্রতিবেদন

লঞ্চ দুর্ঘটনার আসামিরা দুষ্টুপ্রকৃতির, পেরে ওঠে না রাষ্ট্রপক্ষ!

দেশে দিন দিন বেড়েই চলছে লঞ্চ দুর্ঘটনা। মৃত্যুর সারিও দীর্ঘ হচ্ছে। মামলার আসামিরা শাস্তি না পাওয়ায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। এছাড়া আসামিপক্ষের অধিকাংশই প্রভাবশালী। তারা দুষ্টুপ্রকৃতির— এ কারণে মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। এমন মন্তব্য দেশের একমাত্র নৌ-আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) পারভীন সুলতানার।

Advertisement

দেশে বড় লঞ্চ দুর্ঘটনার ১৮টি মামলা নৌ-আদালতে চলমান। এর মধ্যে পিনাক-৬, এমভি মিরাজ, এমভি বন্ধন, এমভি সারথীর মতো বড় বড় মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে। কিছু আসামি আছেন, তারা প্রভাব খাটিয়ে সামান্য কারণেই উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাগুলোর ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।

সর্বশেষ গতকাল সোমবার (২৯ জুন) সকাল ৯টার দিকে মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা দোতলা মর্নিং বার্ড লঞ্চটি সদরঘাট কাঠপট্টি ঘাটে ভেড়ানোর আগ মুহূর্তে চাঁদপুরগামী ময়ূর-২ লঞ্চটি ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চডুবির ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্ঘটনার ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় পর জীবিত উদ্ধার করা হয় সুমন নামের এক ব্যক্তিকে। বর্তমানে তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশীদ-উন নবী বলেন, ‘সুমন বেপারী এখন ভালো আছেন, কথাবার্তা বলছেন। তাকে মেডিসিন ওয়ার্ডে নেয়া হয়েছে।’

ওই দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে মনে হয়েছে এটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এ ক্ষেত্রে লঞ্চমালিকদের গাফিলতি আছে কি-না, খতিয়ে দেখা হবে। তিনি এ সময় তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও জানান।

Advertisement

লঞ্চডুবির ওই ঘটনায় মঙ্গলবার ভোরে নৌ-পুলিশ সদরঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ শামসুল বাদী হয়ে সাতজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলায় ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোফাজ্জল হামিদ ছোয়াদসহ সাতজন আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ১৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন আদালত

দেশের একমাত্র নৌ-আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) পারভীন সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, দেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার ১৮টি মামলা নৌ-আদালতে চলমান। আসামিপক্ষ অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় মামলার কার্যক্রম পরিচালনা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সাক্ষীদেরও খুঁজে পাওয়া যায় না। মূলত এ দুই কারণেই মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।

‘এছাড়া এসব মামলায় শাস্তি কম। সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর। আমরা তিন থেকে চারটি ধারা মিলিয়ে অপরাধীদের ৮-৯ বছর শাস্তি দিতে সক্ষম হই। আসামিরা দু-এক বছর জেলে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসেন।’

তিনি আরও বলেন, দেশের ভয়াবহ লঞ্চ দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালে। পিনাক-৬ লঞ্চটি ডুবে সরকারি হিসাবে ৪৯ জন এবং বেসরকারি হিসাবে ৮৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু পিনাকের মামলার আসামিরা উচ্চ আদালতে গিয়ে বিচার কার্যক্রম স্থগিত করেন। আমরা এ বিষয়ে জবাব দেয়ার পরও মামলার কার্যক্রম এখনও চালু হয়নি। বড় বড় মামলা উচ্চ আদালতে এভাবে পেন্ডিং থাকছে।

Advertisement

নৌ-আদালতে আসামিপক্ষের হয়ে সবচেয়ে বেশি মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা ও সাক্ষী হাজির না হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বড় দুর্ঘটনার মামলাগুলো উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে আছে। এর মধ্যে পিনাক-৬, এমভি মিরাজ, এমভি বন্ধন, এমভি সারথীর মামলা উল্লেখযোগ্য।

‘মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের কার্যকর তেমন কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। সময়মতো সাক্ষীও হাজির হন না। এছাড়া আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় সামান্য কারণেই উচ্চ আদালতে চলে যান। উচ্চ আদালতে গিয়ে তারা বছরের পর বছর মামলা স্থগিত করে রাখেন। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া।’

দেশের উল্লেখযোগ্য সব লঞ্চ দুর্ঘটনা

এমভি সালাউদ্দিন : ২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনল সংলগ্ন মেঘনায় ডুবে যায় সালাহউদ্দিন-২ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ। ওই দুর্ঘটনায় ভোলা ও পটুয়াখালী জেলার ৩৬৩ যাত্রী মারা যান।

এমভি নাসরিন : ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে লালমোহনগামী ‘এমভি নাসরিন-১’ চাঁদপুরের ডাকাতিয়া এলাকায় অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাইয়ের কারণে পানির তোড়ে তলা ফেটে যায়। দুই হাজারের বেশি যাত্রীসহ এটি ডুবে যায়। ওই দুর্ঘটনায় ১২৮ পরিবারের প্রধানসহ সরকারিভাবে ৬৪১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে মরদেহ উদ্ধার করা হয় প্রায় ৮০০ জনের।

এমভি লাইটিং সান : ২০০৪ সালের ২২ মে আনন্দ বাজারে ‘এমভি লাইটিং সান’ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৮১ জন এবং ‘এমভি দিগন্ত’ ডুবির ঘটনায় শতাধিক যাত্রীর মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ভৈরবের মেঘনা নদীতে এমএল মজলিসপুর ডুবে ৯০ জনের মৃত্যু হয়।

এমএল শাহ পরাণ : ২০০৬ সালে মেঘনা সেতুর কাছে ‘এমএল শাহ পরাণ’ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ১৯ জন মারা যায়।

এমভি মিরাজ : ২০১৪ সালের ১৫ মে মুন্সিগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মিরাজ-৪ ডুবে যাওয়ার পর অন্তত ২২ যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দুশ’র বেশি যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ঢাকা থেকে শরীয়তপুরের সুরেশ্বরের দিকে যাচ্ছিল।

পিনাক- ৬ : ২০১৪ সালে ৪ আগস্ট। স্মরণকালের ভয়াবহ লঞ্চডুবি ঘটে পদ্মার বুকে। ঈদের পর হওয়ায় লঞ্চে ছিল ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী। ভরা বর্ষার উত্তাল পদ্মায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬। সরকারিভাবে ওই দুর্ঘটনায় ৪৯ জন এবং বেসরকারি হিসাবে ৮৬ জন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। জীবিত কিছু যাত্রী উদ্ধার হন বিভিন্ন উপায়ে। নিখোঁজ থাকেন ৫৩ জন। যাদের হদিস আজও মেলেনি।

গ্রীন লাইন : ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল বরিশাল সদর উপজেলার কীর্তনখোলা নদীর বেলতলা খেয়াঘাট এলাকায় বালুবাহী একটি কার্গোর ধাক্কায় এমভি গ্রীন লাইন-২ লঞ্চের তলা ফেটে যায়। লঞ্চটি তাৎক্ষণিক তীরের ধারে নেয়ায় দুই শতাধিক যাত্রী প্রাণে বেঁচে যায়।

তিন লঞ্চডুবি : ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মা নদীর ওয়াপদা চেয়ারম্যান ঘাটের টার্মিনালে তীব্র স্রোতে ডুবে যায় তিনটি লঞ্চ। এতে একই পরিবারের তিনজনসহ লঞ্চ স্টাফ ও যাত্রী মিলিয়ে ২২ জন ছিলেন।

এমভি রিয়াদ : ২০১৯ সালের ২২ জুন মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে এমভি রিয়াদ নামের একটি লঞ্চের তলা ফেটে অর্ধেক পানিতে ডুবে যায়। লঞ্চের তলা ফেটে পানি উঠতে শুরু করলে অন্য ট্রলার গিয়ে লঞ্চযাত্রীদের উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসে।

দুই লঞ্চের সংঘর্ষ : ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি বরিশাল-ঢাকা নৌপথের মেঘনা নদীর চাঁদপুর সংলগ্ন মাঝ কাজীর চর এলাকায় মাঝ নদীতে দুই লঞ্চের সংঘর্ষে দুই যাত্রী নিহত এবং আটজন আহত হন।

জেএ/এমএআর/এমএস